জাহিদুল ইসলাম

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২৪

চক্রের কারসাজিতে চালের দাম চড়া

নভেম্বরের মাঝামাঝি শুরু হয়েছিল আমন ধান কাটার উৎসব। তারপর বাজারে উঠতে শুরু করেছে নতুন চাল। আছে আউশের পর্যাপ্ত মজুদও। এরপরও নির্বাচনের পরদিন থেকে দেশব্যাপী চালের দাম বেড়েছে হুহু করে। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে অনুকূল মৌসুমে চালের দাম বরং কমার কথা। সেখানে এভাবে দাম বেড়ে যাওয়ায় সংক্ষুব্ধ রয়েছেন ক্রেতা সাধারণ। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন ধরনের চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিলার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অনেকের সমন্বয়ে বিভিন্ন চক্রের কারসাজিতে এই দাম বাড়ানো হচ্ছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে চক্র বা সিন্ডিকেটের কথা বলা হলেও তা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ফলে ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের মধ্যে।

দেশের উত্তর ও দক্ষিণের মোকামগুলো থেকে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন প্রতি ট্রাকে ৩০০ বস্তা করে ৫০ ট্রাক চাল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারে এবং ৭৫ ট্রাক চাক্তাই চালপট্টিতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে মোকাম মালিকরা চাল পাঠাতে গড়িমসি করছেন। সরকারের কাছে চালের যে মজুদ রয়েছে, এর চেয়ে কয়েকগুণ মজুদ রয়েছে চালকলগুলোয়।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ানবাজার ঘুরে দেখা যায়, গত মাসে বিআর চালের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছে ২৮০০ টাকায়, নির্বাচনের পর গত ১৩ জানুয়ারি সেই চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৯০০ টাকায়। চাল ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, ২৯০০ টাকা দাম শুধু নিয়মিত ক্রেতাদের জন্য। এতে আমাদের তেমন ব্যবসা থাকে না। তবে নিয়মিত ক্রেতাদের বাইরে হলে এই বস্তা ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এছাড়া আমাদের খরচে পোষায় না।

একই বাজারের আরেক ব্যবসায়ী আবু রায়হান বলেন, নতুন ধান উঠেছে। আমরা ভেবেছিলাম, দাম কমে যাবে। কিন্তু এখন উল্টো বেড়ে গেল। কিন্তু কেন বাড়ল সেটা কেউ জানে না। নাম প্রকাশ না করে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, নির্বাচনের পরই যেভাবে দাম বাড়লো মনে হয় ব্যবসায়ীরা বিজয়ের উৎসব পালন করছে।

গত রবিবার রাজধানীর পলাশী বাজার, নিউমার্কেট কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজারে সপ্তাহখানেক আগে স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের কেজি ৫০-৫২ টাকা ছিল, তা কিনতে হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকায়। পাইজাম ও বিআর ২৮ কেজি ৫৫-৫৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬২ টাকা। মিনিকেট ও নাজিরশাইল ৬২-৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬৮ থেকে ৮০ টাকা হয়েছে।

দেশের অন্যতম প্রধান চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে গত দুই সপ্তাহে চালের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৩-৪ টাকা। এভাবে বিভিন্ন চালের মোকামে চালের দাম বেড়েছে।

রাজধানীর মিরপুর-১১ কাঁচাবাজারের চাল ব্যবসায়ী আবু নাছের প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা সাধারণত দিনাজপুর, শেরপুর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চাল সংগ্রহ করি। হঠাৎ করেই এসব জেলায় চালের দাম বেড়ে গেছে। ফলে আমাদেরও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।

রাজধানীর শাজাহানপুর বাজারের চাল ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচনের পরদিন থেকেই এখন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রতি বস্তায় ১০০ টাকা করে দাম বাড়াচ্ছে মিলাররা। দাম কেন বেশি এই কথা জিজ্ঞেস করলেই ফোন কেটে দিচ্ছে। দাম কমার সম্ভাবনা নিয়ে বলেন, এজন্য সরকারের উচিত মিলারদের নিয়ে বসা। কেন তারা দাম বাড়াচ্ছে তা জানতে চাওয়া। তিনি জানান, মিলাররা বলছে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ধানের দাম বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- একদিনের ব্যবধানে কীভাবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়? যেসব মিলার বেশি দাম নিচ্ছে তাদের কঠোর মনিটরিং ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্যও তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।

এদিকে চট্টগ্রামের বাকলিয়া প্রতিনিধি জানান, এই উপজেলার চাক্তাই দেশের অন্যতম বড় চালের পাইকারি বাজার। গত ৮ জানুয়ারি থেকেই এখানে চালের দামে ঊর্ধ্বগতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৬ জানুয়ারি পাইকারি বাজারে জিরাশাইল প্রতি বস্তা ৩১৫০ টাকা, পাইজাম ২৫০০ টাকা, নূরজাহান ২৩০০ টাকা, মিনিকেট ২৩৫০ টাকা, ভিয়েতনামের বেতি ২২৫০ টাকা ও দেশি বেতি ২৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ গত সোমবার (১৫ জানুয়ারি) প্রতি বস্তা জিরাশাইল ৩৩০০ টাকা, পাইজাম ২৬৫০ টাকা, নূরজাহান ২৫০০ টাকা, মিনিকেট ২৭০০ টাকা, ভিয়েতনামের বেতি ২৫০০ টাকা ও দেশি বেতি ২৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া আতপ চালের মধ্যে কাটারিপ্রতি বস্তায় ৪০০ টাকা বেড়ে ৩৬০০ টাকা, মিনিকেট ৩০০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার টাকা, নাজিরশাইল ২০০ টাকা বেড়ে ৩৬০০ টাকায় এবং চিনিগুঁড়া চাল প্রতি বস্তায় ১০০০ টাকা বেড়ে সাত হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি বিভাগের তথ্যানুসারে, দেশে মূলত: আউশ, আমন ও বোরো-এই তিন জাতের ধানের আবাদ হয়ে থাকে। এর মধ্যে আউশের মৌসুম মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত। জুন-জুলাই মাসে অর্থাৎ বর্ষায় আমন ধান বোনা হয় এবং নভেম্বর মাসে বা হেমন্তে সেই ধান কাটা হয়। অপরদিকে বোরো ধান শীতকালীন শস্য। আমনের মৌসুম শেষ হবার পর ডিসেম্বর-জানুয়ারি থেকে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই ধানের সময় চলে। ফলে আমনের এই মৌসুমে চালের দাম বাড়ার যৌক্তিক কারণ নেই।

রাজধানীর মেরাদিয়া বাজারের এক ক্রেতা সোনাহর আলী বলেন, এমনিতেই আমরা দীর্ঘদিন ধরে বেতনের সঙ্গে বাজারের সমন্বয়ের জন্য লড়াই করছি। কিন্তু কোনভাবেই টিকতে পারছি না। আগে সঞ্চয়ী একাউন্টে প্রতিমাসে অল্প কিছু টাকা রাখতাম। গত এক বছর ধরে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে নির্বাচনের পর চালের দাম যেভাবে বাড়ছে তা যেন আমাদের মতো মানুষদের জন্য বহু যন্ত্রণার। অবশ্য এই দাম বৃদ্ধির পরই বাজারে চট্টগ্রামের পাইকারী চালের বাজারে অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসন। বাজার তদারকি টিম ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, চালের পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। তবু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। মূলত সিন্ডিকেট করে বাজার অস্থির করে তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।

গত সোমবার নগরীর পাহাড়তলী বাজারে চালের আড়তে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে লাইসেন্স প্রদর্শন করতে না পারায় একটি চালের আড়তের মালিককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি একাধিক আড়তদারকে মজুদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) উমর ফারুক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত।

সেখানকার পাইকারি বিক্রেতারা জানিয়েছেন, চালের বাজার অস্থির করার ক্ষেত্রে চালকল মালিক (মিলার) ও আড়তদাররা দায়ী। তারা বাজারে চাল ছাড়ছেন প্রয়োজনের চেয়ে কম। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় বাড়ছে চালের দাম।

বিভিন্ন জেলা প্রশাসনে বলছে, ট্রেড লাইসেন্স বা লাইসেন্স ছাড়া অনেকে ধান-চাল মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। এসব ধান-চাল মজুদকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মিলার ও আড়তদাররা যাতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সে ব্যাপারে নজর দেওয়া হচ্ছে।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদা ও জোগানের ওপর ভিত্তি করে এখন চালের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় না। সিন্ডিকেটই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। করপোরেট হাউজগুলো ও মিলাররা বাজার থেকে ধান কিনে নিজেদের গুদামে মজুদ করায় চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্য সংকটের গুজব রটিয়ে কিছু কিছু মোকাম মালিকও চাল মজুদ করছেন।

ক্র্যাব সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, চালের বাজারের অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা কিছু দিন সংযত ছিলেন। এখন তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এদের থামাতে হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বাজার পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।

দ্বিতীয় মেয়াদে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে গত রবিবার খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, দেশে ধান উৎপাদন ভালো হয়েছে এবং খাদ্যের মজুদ পরিস্থিতিও ভালো। তিনি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি বলেছেন, মিলাররা প্রতিযোগিতা করে ধান কেনায় প্রতিনিয়ত চালের দাম বাড়ছে। এজন্য অভিযান জোরদার করা হবে বলে অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close