মংক্যচিং মারমা, ইবি

  ৩১ মার্চ, ২০২৪

অধ্যাপক ছাড়াই চলছে ইবির ১৪ বিভাগ

স্থায়ী অধ্যাপক ছাড়াই শ্রেণি কার্যক্রম চলছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ১৪টি বিভাগে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে এসে অভিজ্ঞ শিক্ষকের কৌশলী পাঠদান, ভালো মানের গবেষণাসহ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে এসব বিভাগে প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া হলেও অধ্যাপক পদে হয়নি। তবে কয়েকটি বিভাগে অধ্যাপক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলেও আবেদনকারী পাওয়া যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ফলে পদগুলোর পরিবর্তে প্রভাষক এবং সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকটি ক্ষেত্রে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টির মফস্বল এলাকায় অবস্থান করা এবং ভিন্ন জায়গায় একই চাকরিতে ভালো সুযোগ-সুবিধা থাকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে চান না অধ্যাপকরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি অনুষদভুক্ত ৩৫টি বিভাগ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি বিভাগে অধ্যাপক রয়েছে ২৪৪ জন, সহযোগী অধ্যাপক রয়েছে ১৪টি বিভাগে ৫৪ জন, সহকারী অধ্যাপক রয়েছে ২২টি বিভাগে ৭৫ জন এবং ১০টি বিভাগে প্রভাষক ২০ জন রয়েছেন।

তবে ২২টি বিভাগে ২৪৪ জন অধ্যাপক থাকলেও সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগ, সমাজকল্যাণ বিভাগ, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগ, আইন অনুষদভুক্ত ল’ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদভুক্ত মার্কেটিং বিভাগ, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগ, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ, প্রকৌশল অনুষদভুক্ত বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ফার্মেসি বিভাগ, কলা অনুষদভুক্ত ফাইন আর্টস বিভাগে এখনো কোনো অধ্যাপক নেই।

এদিকে ফাইন আর্টস ও শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ দুটিতে অধ্যাপক ছাড়াও নেই কোনো সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক। তবে ফার্মেসি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ৪ জন থাকলেও শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন ২ জন। ফলে শিক্ষক সঙ্কটে সেশন জটেরও আশঙ্কা বাড়ছে বিভাগগুলোতে।

এ বিষয়ে কথা হয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক এ এইচ এম নাহিদের সঙ্গে। তিনি অধ্যাপকের চেয়ে একটি বিভাগে অবকাঠামোর গুরুত্ব বেশি বলে মনে করেন। তিনি বলেন, অবশ্যই একজন অধ্যাপক যে সার্ভিস দিতে পারবে তা সবাই পারবে না। তবে অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছা শক্তির ওপর বিষয়গুলো নির্ভর করে। নতুন যে বিভাগগুলো সেগুলোর বেশিরভাগ অবকাঠামোগত দিক দিয়ে নানা সমস্যায় ভোগে। যদি ক্লাস করার জায়গা না পায় তাহলে লেকচারার দিয়েই বা কী করব আর অধ্যাপক দিয়েই বা কী করব? তবে আমরা এত সংকটের মধ্যে দিয়েও আমরা আমাদের ক্লাস পরীক্ষা চলমান রেখে আমাদের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিচ্ছি।

ফাইন আর্টস বিভাগে কোনো অধ্যাপক না থাকায় বিভাগটিতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত আছেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এইচ এম আক্তারুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিভাগে সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পরে আমি যতটুকু শুনেছি, বিভাগে শেষ দুবার যে নিয়োগ হয়েছে দুবারই সিনিয়র পদের সার্কুলার ছিল। সে সময় কোনো আবেদন না থাকায় পদগুলোতে প্রভাষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একটি বিভাগ থাকার মানে হচ্ছে সে বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক ৪টি পদই জরুরি।

তিনি আরো বলেন, একজন সদ্য পড়াশোনা শেষ করা প্রভাষক আর একজন অধ্যাপকের মধ্যে অনেক তফাৎ। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও অনেক কিছু শেখার বিষয় থাকে। যেসব বিভাগে জুনিয়র সভাপতি আছে তারা অনেকেই ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে উসকে দেয় বলে শুনেছি। যদি এসব বিভাগগুলোতে সিনিয়র শিক্ষক থাকত তবে এসব হতো না।

একজন অধ্যাপক এবং একজন প্রভাষকের কাছে শিক্ষার্থীরা যে জ্ঞান অর্জন করে তাদের মধ্যে কোনো তারতম্য হয় কি না জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুল মুঈদ বলেন, একজন প্রভাষক আর অধ্যাপকের পাঠদানের মধ্যে তারতম্য তো আছে। এমন তো না একটা মানুষ হুট করে অধ্যাপক হয়ে গেল। তাকে কিন্তু ১০-২০ বছর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ধাপ পার হয়েই এই জায়গায় আসতে হয়। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে শিক্ষার্থীরা অনার্স-মাস্টার্স পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছে অথচ কোনো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকের পাঠদান পায়নি।

তিনি বলেন, তাই মন চাইলেই একটি বিভাগ খোলা উচিত না। যদিও এতে আইনগতভাবে কোনো অসুবিধা নেই। তবে নীতিগতভাবে নিয়ম হচ্ছে বিভাগটিতে শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়ার আগে প্রথমে অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া। নিয়োগ পাওয়ার পরে সেই অধ্যাপক এক বছর ধরে কারিকুলাম সাজাবে, তৈরি করবে এবং কোর্স ডিজাইন করবে। ডিজাইন করার পরই অন্যান্য নিয়োগগুলো দিয়ে বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি করা।

অধ্যাপক মুঈদ আরো বলেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যে শিক্ষক নেব সে যেন আমার বগলে থাকে, আমার অধীনস্থ থাকে এবং আনুগত্যে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাষক নিলে কথাবার্তা শুনবে এই ভেবে নেওয়া হয়। রাজনৈতিকভাবে এটি লাভজনক হলেও আসলে এটি এক ধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং দূরদর্শিতার অভাব। এতে শিক্ষার্থীদের ঠকানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এইচ এইম আলী হাসান বলেন, আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সরাসরিভাবে অধ্যাপক পদে কারো নিয়োগ হয় না পদোন্নতির মাধ্যমে শিক্ষকরা এটি পেয়ে থাকেন। তবে আমরা কয়েকটি বিভাগে কয়েকবার অধ্যাপক পদে নিয়োগের সার্কুলার ছাড়লেও কোনো আবদেন আসেনি। এখন বিভাগগুলো যদি পদ খালি থাকাসাপেক্ষে প্ল্যানিং করে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করে তাহলে আমরা আবার সার্কুলার ছাড়তে পারি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত আসে সাধারণত বিভাগগুলোর প্ল্যানিং কমিটি থেকে। অধ্যাপক পাওয়া যেহেতু কঠিন তাই আমরা চেষ্টা করি নিচের দিকের পোস্টগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র দুটি। কোনো বিভাগে অধ্যাপক নেই আবার কোনো বিভাগে শুধু অধ্যাপক আছে লেকচারার নেই। এ নিয়ে বিভাগগুলোর কোনো উদ্যোগও আমি দেখি না। এখন পর্যন্ত যেসব বিভাগে অধ্যাপক আছে লেকচারার নেই এমন কোনো বিভাগ থেকে ফাইল আসেনি। তবে কিছু বিভাগের কথা আমি শুনেছি যে তারা অপেক্ষায় আছেন কখন তারা অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপকের যোগ্যতা অর্জন করবেন। তারপরই তখন এই বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন।

তিনি বলেন, আমরা শিক্ষক নিয়োগের সার্কুলার ছাড়লেও তেমন কোনো সাড়া পাই না। শেষ যে বিভাগে নিয়োগ ছিল সেখানেও মাত্র তিনটি আবেদন পেয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষা দিয়েছিল দুজন। শিক্ষক নিয়োগে আবেদন না করতে চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, প্রথমত হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়টি মফস্বলে, দ্বিতীয়ত একই বিষয়ে ভিন্ন জায়গায় ভালো সুযোগ।

অধ্যাপকের মাধ্যমে পাঠদান না পাওয়া শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, জ্ঞানের ঘাটতি থাকছে কি না তা এভাবে বলা যাবে না। কারণ আমাদের নতুন যারা শিক্ষক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, লেকচারার এরাও তো অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট তবে হ্যাঁ একজন অধ্যাপক বা একজন গার্ডিয়ানতুল্য বয়সি একজন বিভাগে থাকলে বহু সমস্যার সমাধান সম্ভব হতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close