নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২৪

ঐতিহ্য

নতুনরূপে ঢাকা গেট

৪০০ বছরের স্থাপনায় সংস্কার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কার্জন হল ছাড়িয়ে দোয়েল চত্বর। সেটা পেরিয়ে বাংলা একাডেমির পথে একটু এগোতেই চোখে পড়বে মীর জুমলার ফটক বা ঢাকা গেটের নতুনরূপ। বাংলার সুবেদার মীর জুমলার নামে নামকরণকৃত এই ফটক ঢাকার নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল ৪০০ বছর আগে। কালের পরিক্রমায় স্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছিল মোগল আমলের এই নান্দনিক স্থাপত্য। সেই স্থাপনাই নতুন রূপে ফিরিয়ে এনেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ফটকটিকে আরো নান্দনিক করতে সঙ্গে স্থাপন করা হয়েছে মীর জুমলার কামানটিও।

ইসলাম খাঁর (প্রকৃত নাম শেখ আলাউদ্দিন চিশতি ১৫৭০-১৬১৩) আমলে রমনা অঞ্চলে ছিল ‘বাগে বাদশাহি’ নামক মোগল উদ্যান। বাগে বাদশাহির প্রবেশপথে দুটি স্তম্ভ ছিল। পরে গেটটি পুনর্নির্মাণ করে নামকরণ করা হয় ‘ঢাকা গেট’। মোগল আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে ঢাকায় ঢোকার ‘প্রবেশমুখ’ ছিল এ তোরণ। পরে কখনো ‘ময়মনসিংহ গেট’, কখনো ‘ঢাকা গেট’, আবার কখনো ‘রমনা গেট’ নাম ছিল এটির।

বহু বছরের অযত্ন-অবহেলায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে গেটটির নান্দনিকতা। মুছে যেতে থাকে এর শেষ চিহ্নটুকুও। সম্প্রতি ঢাকা শহরকে একটি পর্যটকবান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তুলতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি। এরই অংশ হিসেবে ঐতিহাসিক ঢাকা গেটকে নান্দনিকতায় ফেরাতে সংস্কার কাজ শুরু করে গত বছর। ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের শিক্ষক স্থপতি ড. আবু সাঈদের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ দল গেটটির নতুন এই রূপ দিয়েছেন।

ড. আবু সাঈদ বলেন, ব্রিটিশ আমলে ম্যাজিস্ট্রেট ডয়লির সময় এই গেট তৈরি করা হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রমাণ মেলে। এই গেটের এখন তিনটি অংশ দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু শুরুতে এমনটি ছিল না। শুরুতে রাস্তাটি এক লেনের হওয়ায় গেটের দুটি অংশ ছিল। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে রাস্তাটি যখন দুই লেন করা হয় তখন এর একটি অংশ ভেঙে ফেলা হয়। তিন নেতার মাজারের অংশটি নতুন করে তৈরি করা হয়। দুই রাস্তার মাঝের পিলারটি সেই ভাঙা অংশেরই একটি। আদি যে চুন-সুরকির প্লাস্টার দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল, সেই একই উপকরণ দিয়েই আমরা এটি সংস্কার করেছি। আদি ডয়লির অংশটি ও ৬০ দশকের অংশটি আনা হয়েছে। ওসমানী উদ্যান থেকে মীর জুমলার কামানও নতুন করে এনে স্থাপন করা হয়েছে।

গতকাল বুধবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, সংস্কারের পর গেটের অংশগুলো আগের রূপে ফিরিয়ে সেখানে নান্দনিক চত্বর করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে বসার স্থান। তবে এখনো সবার জন্য পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়নি। যদিও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কজন দর্শনার্থীকে চোখে পড়ল। তারা নতুন এই স্থাপত্যকর্মের ছবি তুলছিলেন। ঘুরে ঘুরে স্থাপত্যকর্ম দেখেছিলেন। বিশেষ করে মীর জুমলার কামানটি নিয়েই দর্শনার্থীদের বেশি আগ্রহ চোখে পড়ল। স্থাপত্যের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মী রবিউল ইসলাম জানান, বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও পথচারী ও দর্শনার্থীরা আসছেন গেল কয়েক দিন ধরেই। ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়া হলেও অনেক দর্শনার্থীই নান্দনিক এই জায়গাটিতে ছবি তুলতে আসছেন নিয়মিত।

এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ৫০ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছি। ঢাকার প্রাণই হচ্ছে এসব স্থাপত্য। অথচ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে বেশিরভাগ স্থাপনাই। বর্তমান মেয়র ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা করার একটি বড় প্রকল্প নিয়েছেন। ঢাকা গেটের কাজ শেষ হয়েছে। নর্থব্রুক গেট সংরক্ষণের কাজ চলছে। আশা করছি, সিটি করপোরেশন আরো উদ্যোগ বাড়াবে।

ঢাকা গেট ও মীর জুমলার কামানের ইতিহাস : কখন এবং কেন রমনার এই ফটকটি নির্মাণ হয়েছিল তা নিয়ে অবশ্য ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। তবে এটি মোগল আমলেই নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মনে করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকা কোষের তথ্য মতে, ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করতে এবং স্থলপথে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ঢাকা গেট নির্মাণ করেন মীর জুমলা। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মীর জুমলা ছিলেন বাংলার সুবেদার (মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক)। কয়েক শতাব্দী ধরে এই গেটটিকে রূপান্তর করা হয়। ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডাউস এটি পুনর্নির্মাণ করার পর এর নাম দেন ‘রমনা গেট’। ব্রিটিশ শাসনের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসন চলাকালীন গেটটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

অন্যদিকে, মীর জুমলার কামানের আসল নাম বিবি মরিয়াম কামান। তবে এটি মীর জুমলার কামান হিসেবে সমধিক পরিচিত। ৬৪ হাজার ৮১৫ পাউন্ড ওজনের কামানটি ১৭ শতকের মাঝামাঝিতে আসাম অভিযানের পর বাংলা সুবেদার রাজধানী ঢাকার বড় কাটরার সামনে সোয়ারীঘাটে স্থাপন করেন। এক সময় কামানটি অর্ধেক বালির নিচে তলিয়ে গেলে ১৮৪০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াল্টার্স চকবাজার এলাকায় স্থাপন করেন। এরপর আরো কয়েকবার স্থান বদল হয়। ঢাকা জাদুঘরের পরিচালক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর উৎসাহে ১৯২৫ সালে কামানটিকে সদরঘাটে স্থাপন করা হয়। ১৯৫৭ সালে ডিআইটির সভাপতি জি এ মাদানী তৎকালীন ডিআইটি অ্যাভিনিউয় তথা গুলিস্তানে স্থানান্তর করেন। সেখানে তিন যুগ অবস্থানের পর ১৯৮৩ সালে ওসমানী উদ্যানে স্থানান্তর হয়। আর সর্বশেষ সদ্য সংস্কারকৃত ঢাকা গেটের পাশে স্থাপিত হয়েছে কামানটি। সে হিসেবে এ কামানও নিছক যুদ্ধের সরঞ্জাম হয়ে থাকেনি, হয়েছে ঢাকার ঐতিহাসিক বাঁক বদলের সাক্ষী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close