নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১২ জানুয়ারি, ২০২৪

গরম পানিতে পোড়া শিশু বাড়ছে হাসপাতালে

চিকিৎসক-নার্সসহ কয়েকজন ধরে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন তিন বছরের শিশু মাহিনকে। ছোট্ট শিশুটির চিৎকারে ভারী হয়ে উঠছে হাসপাতালের কক্ষ। চিকিৎসকরা শান্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না কিছুতেই। অদূরে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন মাহিনের দাদি রাশিকা। আরো কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তার মা। সবাই অশ্রুসজল।

মাহিনের দাদি রাশিকা প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, কাপড় ধোয়ার জন্য গরম পানি রাখা ছিল। মাহিন গাড়ি নিয়ে খেলছিল। হঠাৎ পড়ে যায় গরম পানিতে। তার বাম পাশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝলসে গেছে হাত, পা ও পেট। চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

দুই বছরের শিশু আবদুর রহমান। গরম পানিতে ঝলসে গেছে তার পুরো মুখ। ফুটফুটে শিশুটির পুরো মুখ ঝলসে চামড়া সাদা হয়ে আছে। বাবা-মা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। তারা এসেছেন ঢাকার সাভার এলাকা থেকে।

আবদুর রহমানের মা খাদিজা আক্তার জানান, পাশের বাসায় কাপড় ধোয়ার জন্য গরম পানি করে রুম থেকে বের হচ্ছিলেন একজন। রুমের সামনে ছিল পর্দা। সেটি ভেদ করে দৌড়ে রুমে যাচ্ছিল আবদুর রহমান। এ সময় দুজনে ধাক্কা লেগে গরম পানি তার মুখে পড়ে। ফলে ঝলসে গেছে পুরো মুখ।

চিকিৎসকরা বলছেন, শীত মৌসুম শুরু হলেই এ ধরনের রোগী বাড়ে হাসপাতালে। কারণ এ সময় মানুষ উষ্ণতার জন্য আগুন ও গরম পানির ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়। গরম পানি, চা, দুধ, তরকারি, ডাল, ভাতের মাড় ইত্যাদি পড়ে গিয়ে পুড়ে যাওয়া শিশুরা আসে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের ৪৫ শতাংশই শিশু। এ শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসছে উত্তপ্ত তরলজাতীয় গরম পানি, গরম ডাল কিংবা তরকারি পড়ে আক্রান্ত শিশুরা। চিকিৎসকরা বলছেন, আগুনে পোড়া কোনো জীবাণুঘটিত রোগ নয়, দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে প্রয়োজন সচেতনতা। পরিবারে সচেতনতা বৃদ্ধি শিশুদের দুর্ঘটনার বড় অংশই কমাবে।

সরেজমিন বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও আউটডোরে শিশুদের কান্নার আওয়াজ। ড্রেসিং করার সময় তাদের কান্না কাঁদাচ্ছিল বাকিদের। কারো হাত, পা, পেট পুড়েছে। কেউ এসেছে ইলেকট্রিক বার্ন নিয়ে। কারো মুখ ঝলসে গেছে গরম পানিতে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, উত্তপ্ত তরলে পোড়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপক হারে। গত বছরের নভেম্বর মাসে ৮১০ জন রোগী দগ্ধ হয়ে ছুটে এসেছিলেন হাসপাতালে। অন্যদিকে ২০২৩ সালের জুন মাসে মোট যত সংখ্যক পোড়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছিলেন, তার প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক রোগী অক্টোবরে শুধু গরম পানিতে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মতে, শীত এলেই বাড়ে পোড়া রোগী। হাসপাতালের তথ্যে জানা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে এ ধরনের ৫০ জনের মতো রোগী আসছেন, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু। নভেম্বরে যে ৮১০ জন দগ্ধ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তার মধ্যে ৫০০ জনের মতোই উত্তপ্ত তরলে দগ্ধ হয়েছিলেন।

হাসপাতালের আউটডোরের চিত্রও ঠিক একই রকম। আউটডোরে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ রোগী গড়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রোগী আসেন ৫ হাজার ৬৫ জন। এর আগের মাস নভেম্বরে আউটডোরে পোড়া রোগী এসেছেন ৪ হাজার ৪৮১ জন।

আউটডোরে কর্তব্যরত নার্সরা জানান, প্রতিদিন ২৫০ জনের বেশি রোগীর ড্রেসিং করা হয়। এদের মাঝে ৭৫ শতাংশই শিশু ও নারী। এক দিন সরকারি বন্ধ গেলে পরদিন আউটডোরে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ হাসপাতালে পোড়া রোগীদের ড্রেসিংয়ের দায়িত্বে আছেন ১৬ জন নার্স। সকাল থেকেই তাদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়।

বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকদের মতে, শীতে গোসলের জন্য বেশির ভাগ মানুষ গরম পানি করেন শিশুকে গোসল করানো বা নিজে গোসল করার জন্য। এ সময় অসতর্কতায় ঘটে দুর্ঘটনা। এজন্য মায়েদের এবং পরিবারের সদস্যদের উচিত সতর্কতার সঙ্গে গরম পানি ব্যবহার করা। অন্যদিকে গরম পানি এবং গরম খাবারও সচেতনতার সঙ্গেই ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া গরম পানির পাত্র হাত ফসকে গিয়ে যে কারো গায়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে বয়স্ক ও শিশুরা বেশি দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার সুযোগ থাকে।

জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর শীতকাল এলেই আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। গৃহস্থালীতে আমরা গরম পানিসহ যে গরম জিনিস ব্যবহার করি, ফলে ঘরের ভেতরের দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয়। সবচেয়ে বেশি ভিকটিম হয় শিশুরা।

তিনি বলেন, গরম পানি পরিবহনের সময় পাতিলে না রেখে বালতিতে করে নিচু করে নেওয়া হলে এসব দুর্ঘটনা থেকে কিছুটা বাঁচা সম্ভব।

‘এছাড়া খাবার গরম করার পর নিচু জায়গায় এসব না রেখে উঁচু তাকে যদি তুলে রাখা হয় সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের নাগালের বাইরে থাকবে। বর্তমানে ইলেকট্রিক বার্নও অনেক পাচ্ছি। যেমন অনেকে মোবাইল চার্জ দিয়ে চার্জার খোলা রেখে যায়। এ সময় চার্জার মুখে দিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে শিশুরা। আমরা সম্প্রতি কয়েকটা রোগী পেয়েছি। তাদের মুখ, জিহ্বা আক্রান্ত হয়েছে। তাই চার্জার ব্যবহার শেষে বন্ধ করে রাখা উচিত।’ তিনি আরো বলেন, চিকিৎসা দিয়ে এসব রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কিন্তু আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাই সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সচেতনতা। শীতকালে গ্রামগঞ্জে শুকনা পাতা বা কাঠে আগুন ধরিয়ে ওম পোহায় মানুষ। সে ক্ষেত্রেও বয়স্ক ও শিশুদের দগ্ধ হওয়ার শঙ্কা থাকে। বিশেষ করে বৃদ্ধরা আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ বেশি হন। এ ধরনের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close