সুকান্ত দাস
ভোক্তা অধিকার হরণ ও শাস্তি

ভোক্তা হলেন এমন ব্যক্তি যিনি পুনঃবিক্রয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছাড়া মূল্য পরিশোধে বা মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতিতে পণ্য কেনেন বা সেবা কেনেন। আর সঠিকভাবে পণ্য বা সেবা কেনার অধিকারই ভোক্তা অধিকার। বিশেষত দেশের সাধারণ জনগণ যারা টাকার বিনিময়ে দ্রব্য কেনেন, চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন, যানবাহনে যাতায়াত করেন এরা সবাই ভোক্তা। এক কথায় দেশের সবাই ভোক্তা। কারণ সবাই কোনো না কোনোভাবে পণ্য এবং সেবা কেনেন।
অসাধু চক্রের হাত থেকে ভোক্তাদের রক্ষার্থে রয়েছে ভোক্তা অধিকার আইন। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ভোক্তা অধিকার হরণ হচ্ছে বিভিন্নভাবে। বর্তমানে তেলের দাম দেশের একেক জায়গায় একেক রকম নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর ঘটনা দেশে প্রতি বছরই ঘটে। যে পেঁয়াজের দাম ২৫-৩০ টাকা কেজিপ্রতি, সেই পেঁয়াজের দাম ৩০০-৪০০ টাকাও হয়েছে একসময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর চক্রান্তে। এটা ভোক্তা অধিকারের চরম পরিপন্থী।
রমজান মাস আসার আগে প্রতি বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া বিভিন্ন জিনিসের দাম মানে না তারা। সরকারি সিদ্ধান্তেরও কোনো রকম তোয়াক্কা করে না। এতে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতি বছর।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া সময়কালে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নেওয়া এবং ভাড়া ৬০ ভাগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু যে যার মতো করে দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া নিয়েছেন তখন। এ ছাড়া ঈদের সময় যখন গ্রামে যাওয়ার জন্য মানুষের ঢল নামে, তখন ইচ্ছেমতো যানবাহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেয় কিছু অসাধু মানুষ। এটা প্রতি বছরই হয়। আর ভাড়া আদায় নিয়ে গণপরিবহনে যাত্রীদের সঙ্গে বাস কর্তৃপক্ষ এবং কর্মচারীদের বাজে ব্যবহার তো নিত্যদিনের ঘটনা। সবচেয়ে বেশি বাজে ব্যবহারের শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। অনেক সময় তাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়। রেলে টিকিট কালোবাজারি হয়। যে কারণে যাত্রীরা অনেক সময় টিকিট পান না।
দেশের হাসপাতালগুলোর অবস্থা আরো নিদারুণ। ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ক্লিনিক সেন্টারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সংরক্ষণ, লাইসেন্স নবায়ন না করা ও সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা না থাকাসহ আসন-সীমার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করা তো অহরহ ঘটছে। এ ছাড়া যেকোনো পরীক্ষায় বেশি টাকা রাখা তো আছেই। ওষুধের দামও বেশি রাখা হয় মানুষভেদে। এই সবকিছুই ভোক্তা অধিকারের উল্লম্ফন। ভোক্তা অধিকারবিরোধী যেকোনো কাজই দণ্ডনীয় অপরাধ।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে বিশ্বের সব দেশে কাজ করা হয়। ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ করলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। আমেরিকায় নব্বইয়ের দশকের একটি ঘটনা সম্পর্কে জানলে বোঝা যাবে উন্নত দেশগুলো ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে কতটা সতর্ক। ১৯৯৪ সালে ইসা লিসবেক নামের এক মার্কিন নারীর শরীরে ম্যাকডোনাল্ডসের ৫০ সেন্টের কফি পড়ে পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ছয় লাখ ডলার! শুধু স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কফি দেওয়ার অভিযোগে। (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো, ১৫ মার্চ, ২০১৭) আর আমাদের দেশে তো প্রতিনিয়ত ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে জনগণের বহুল প্রতীক্ষিত জনবান্ধব আইন ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯’ মহান সংসদে ২৬ নম্বর আইন হিসেবে পাস করে। আইন হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োগও হচ্ছে কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।
পণ্য বা সেবা কিনে কেউ প্রতারিত হলে যে কেউ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে মামলা করতে পারবেন এবং এই প্রক্রিয়া খুবই সহজ। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে সরাসরি ই-মেইলের (nccc-dncrp.gov.bd) মাধ্যমেও অভিযোগ করা যায়। ই-মেইলে অভিযোগকারীর নাম, পিতা-মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ঘটনার বিবরণ এবং প্রমাণস্বরূপ পণ্য ক্রয়ের রসিদের ছবি সংযুক্ত করতে হবে।
আবার কেউ চাইলে ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮ ও ০৩১-৭৪১২১২ নম্বরে কল দিয়েও অভিযোগ জানাতে পারবেন। এরপর তদন্ত শেষে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে যে আর্থিক জরিমানা করা হবে, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হবে। তবে অভিযোগটি পণ্য কেনার ৩০ দিনের মধ্যে করতে হবে।
ভোক্তা অধিকার আইন রয়েছে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টাও করছে যাতে ভোক্তার অধিকার হরণ না হয়। কিন্তু অসাধু লোকজনকে কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছে না। এজন্য শুধু আইন এবং বিচার করে কাজ হবে না। ভোক্তার অধিকার সমুন্নত রাখতে প্রয়োজন সর্বস্তরের মানুষের এ বিষয়ে সচেতনতা। সরকারের উচিত ভোক্তা অধিকার পরিষদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোক্তা অধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা। তাহলেই খাদ্য ভেজালমুক্ত হবে এবং সঠিক সেবা পাবেন ভোক্তারা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া