মো. আবু সাইদ খোকন, আমতলী (বরগুনা)

  ০৬ নভেম্বর, ২০২২

উপকূলে নভেম্বর আতঙ্ক

‘এনাদার নভেম্বর ইজ কামিং’

ছবি : সংগৃহীত

একসময় বাংলার মায়েরা তাদের শিশুদের বর্গির হাঙ্গামার ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াত। ছড়া-কবিতায় তার প্রমাণ মেলে। চট্টগ্রাম বন্দর যখন পর্তুগিজদের দখলে, তখন উপকূলের অভিশাপ ছিল ঘূর্ণিঝড়। প্রায়ই অক্টোবর/নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেত ঘরবাড়ি। পর্তুগিজ মায়েরা শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য বলত ‘বেবি স্লিপ এনাদার নভেম্বর ইজ কামিং’। শুধু পর্তুগিজ মায়েরাই নয়, নভেম্বর মাস এলেই বরগুনার আমতলীসহ উপকূলীয় এলাকার মানুষকে ভয়ংকর স্মৃতি তাড়িত করে। সিডর, বুলবুল, গ্রেট ভোলা সাইক্লোনসহ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি এখনো তাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। উপকূল এলাকায় বড় বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে নভেম্বরে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের (সিডিএমপি) দুর্যোগ কোষ এবং ডয়েচে ভেলের তথ্য থেকে শুধু নভেম্বর মাসের সংগঠিত ঘূর্ণিঝড়গুলোর বিবরণ দেওয়া হলো।

১৯০৪ সালের নভেম্বরে সোনাদিয়ায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ে ১৪৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। বিষখালী নদীতে বিলীন হয় অর্ধশত বসতবাড়ি।

১৯৭০ সালের ১১-১৩ নভেম্বরে উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’। ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ও সম্পদ বিনষ্টকারী এই ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তরপাশ ও চর তজুমদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণহারায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। চার লাখের মতো বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৩৫ হাজার সমুদ্রনির্ভর মৎস্যজীবী ও ৭২ হাজার অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০ সহস্রাধিক মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। লাখ লাখ গবাদিপশু মারা যায়। চার লাখ ঘরবাড়ি এবং তিন হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামো ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মিটার।

১৯৭১ সালের ৫-৬ নভেম্বরে চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। মানুষ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে। ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়নি। আমতলীসহ বরগুনা উপকূলে অসংখ্য গবাদিপশু মারা যায়।

১৯৭১ সালের ২৮-৩০ নভেম্বরে বরগুনা জেলাসহ সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ৯৫-১১৩ কিলোমিটার গতিবেগে এবং ১-২ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। খুলনা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।

১৯৭৪ সালের ২৪-২৮ নভেম্বরে বরগুনা জেলার পার্শ্ববর্তী সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকূলে ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার বেগে তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং ৩ থেকে ৫ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। ২ শতাধিক মানুষ ও প্রায় ১ হাজার গবাদিপশুর মৃত্যু হয় এবং ২ হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়।

১৯৮৩ সালের ৫-৬ নভেম্বরে ঘণ্টায় ১৩৬ কিলোমিটার বেগে এবং ২ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসের ঘূর্ণিঝড় আমতলী, বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার উপকূল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। অর্ধশত নৌকা ও তিন শতাধিক মৎস্যজীবী নিখোঁজ হয়। ধ্বংস হয় দুই হাজার বসতবাড়ি।

১৯৮৬ সালের ৮-৯ নভেম্বরে বরগুনা, আমতলীর কলাপাড়া, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর চরাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১০ কিলোমিটার, খুলনায় ৯০ কিলোমিটার, বরিশালে ৮০ কিলোমিটার। এতে ১৪ জন নিহত এবং ৯৭ হাজার ২০০ হেক্টর ফসলি জমি বিনষ্ট হয়।

১৯৮৮ সালের ২৪-৩০ নভেম্বরে বরিশাল, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনাসহ উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার বেগে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। মোংলায় চার থেকে পাঁচ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে ৫ হাজার ৭০৮ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৬৫ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। বহুসংখ্যক বন্য পশু মারা যায়।

১৯৯৫ সালের ২১-২৫ নভেম্বরে কক্সবাজারের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার বেগে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রায় ৬৫০ জনের মৃত্যু ও ১৭ হাজার গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী সুপার সাইক্লোন সিডর। বরগুনা, আমতলী, বেতাগী, পাথরঘাটা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলা এই সুপার সাইক্লোন সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিডর প্রায় ছয় হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। রেড ক্রিসেন্টের হিসাবমতে, প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার। সিডর খুলনা ও বরিশাল এলাকায় তাণ্ডব চালায়। সমুদ্র থেকে উঠে আসা ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সবকিছু ভেসে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২ জেলার ২০ লাখ মানুষ। উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ছয় লাখ টন ধান নষ্ট হয়ে যায়। সুন্দরবনের প্রাণীদের পাশাপাশি অসংখ্য গবাদিপশু মারা যায়। জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে বিধ্বস্ত হয় ৮ হাজার ৭৫ কিলোমিটার সড়ক। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ হাজার ৬৮৭টি ব্রিজ-কালভার্ট আর ২ হাজার ২৯০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।

২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। দিনগুলো স্মৃতিচারণ করে আতঙ্কিত থাকে বিষখালী নদী পাড়ের মানুষ। আমতলী উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ মোকাবিলায় ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো সত্ত্বেও মারাত্মক দুর্ঘটনা কিংবা সম্পদের তেমন ক্ষতি হয়নি।

২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ দিয়ে বাংলাদেশে আসায় ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়। ঝড়ে মারা যায় ২৪ জন। ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনেরও। ২০০০ সাল থেকে ঝড়ের নামকরণের জন্য নিয়ম বানানো হয়।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
উপকূল,নভেম্বর আতঙ্ক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close