অলোক আচার্য

  ২০ অক্টোবর, ২০২২

সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ভূমিকা 

সভ্যতা গতিশীল হওয়ার পর থেকে পৃথিবী কখনো শান্ত ছিল না। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধ, দখল এসব ঘটনা ইতিহাসের সাক্ষী। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে বিশ্ব জয় করার স্বপ্ন দেখা রাজা-মহারাজারা। তাতে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে, নদীর জল মানুষের রক্তে লাল হয়েছে কিন্তু রক্ত নিয়ে খেলার ইতিহাস পরিবর্তন হয়নি। উল্টো মানুষ ছুটেছে ভয়ংকর অস্ত্রের পেছনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরই মানুষ বিশ্বযুদ্ধ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয় এবং সে সঙ্গে বিশ্ব যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয় সেজন্য একতাবদ্ধ হয়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের শান্তি রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক উন্নয়নের অন্তরায় দূরীকরণে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশংসনীয়। এটিই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংগঠন।

বহু সমস্যার বিরুদ্ধে কাজ করলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ অতি জরুরি হলেও কিছু বিষয়ের সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। এর কারণ হলো যাদের একত্রিত হয়ে এসব সমস্যার সমাধান করার কথা তারা ঐকমত্যে পৌঁছতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বা হচ্ছে। অথচ এসব ঘটনা পৃথিবীতে মানবতার বিরুদ্ধে কাজ করছে। জাতিসংঘ গঠনের প্রেক্ষাপট ছিল মূলত বিশ্বের শান্তি রক্ষা করার পাশাপাশি বিশ্বকে নিরাপদ করে গড়ে তোলা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশগুলোকে সহায়তা করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হয় জাতিপুঞ্জ। কিন্তু যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো তখন বোঝা গেল শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভিন্ন কিছু প্রয়োজন। জাতিপুঞ্জ এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট জাতিসংঘ গঠনের প্রস্তাব দেন। বর্তমানে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শান্তি রক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্য রাষ্ট্র রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীন এদের ক্ষমতাও অনেক। আর এদের অনৈক্যের কারণেই সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ তার ক্ষমতা প্রদর্শনে সফল হতে পারছে না।

বিশ্বে পরাশক্তি বলতে এ পাঁচটি দেশই প্রধান। আবার বিভক্তি বা বলয় বলতেও কিন্তু এসব দেশই। এ দেশগুলো যদি একভাবে চলত তাহলে পৃথিবীর চেহারা অন্যরকম হতো। জাতিসংঘের পৃথিবীর সমস্যাগুলো সমাধান করতে বেগ পেতে হতো না। একটি যুদ্ধমুক্ত এবং সবার অধিকার নিশ্চিতে যে লক্ষ্য জাতিসংঘে এদের রয়েছে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। উপরন্তু যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্ব এখন নাজেহাল অবস্থা। বাদ যায়নি এসব উন্নত দেশও! আর সব মিলিয়ে তো আগামী বছর খাদ্য সংকট তীব্র হওয়ারও আশঙ্কা। এতকিছু সত্ত্বেও এই রেষারেষি শেষ হচ্ছে না। অস্ত্র ব্যবসা বিশ্বের অন্যতম লাভজনক ব্যবসা! যুদ্ধ মানেই গাদাগাদা অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রি। যে দেশের অস্ত্র যত আধুনিক সে দেশের তত লাভ! রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতির বহু হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতার হিসাব। এ যুদ্ধ পুরোমাত্রায় চলছে।

যুদ্ধ যে মূলত দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে তা অনুমান করা যায়। সেক্ষেত্রে বৈশ্বিক রাজনীতিতে আরো পরিবর্তন ঘটবে। আসতে পারে নতুন জোট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন জোট গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিশেষ করে এ যুদ্ধের শুরু হওয়ার পর জোটের গুরুত্ব বেড়েছে। আবার জোটের গুরুত্ব যেমন প্রসারিত হয়েছে সেভাবেই সমমনা দেশগুলোও নিজেদের অস্তিত্ব, স্বার্থ এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। ফলে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে নিরাপদ করাতে একাধিক দেশ জোটবদ্ধ হচ্ছে বা হতে পারে। এখন জোট গঠনের উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা জোরদার করা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষা করা।

বর্তমান বিশ্বে সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং অন্যান্য দিক মিলিয়ে আমেরিকা বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে এখনো এককভাবেই প্রভাবশালী বলে স্বীকার করতে হয়। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের প্রবণতা এবং এ প্রবণতা থেকেই এক দেশ অন্য পরাশক্তিকে মোকাবিলায় জোটবদ্ধ অবস্থান গড়ে তুলছে।

বিভিন্ন কারণেই বিশ্বে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হলেও এবং এর কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের নিজ বাসভূমে ফেরত পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কৌশলগতভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু সেভাবে তা সম্ভব হয়নি। যদিও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিন্তু তাতে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। আবার যুদ্ধ বন্ধেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। একজন পক্ষে ভোট দেয় তো অন্যজন বিপক্ষে। এভাবেই চলছে। মূলত পৃথিবীটা চলছে স্বার্থের খেলায়। জাতিসংঘ বিশ্বের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফেরাতে উদ্যোগী হলেও বহুক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারছে না। এক্ষেত্রে পরাশক্তি দেশগুলো প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলে আসছে রাশিয়া ও চীনের। জাতিসংঘে সবাই একসঙ্গে একটি সমস্যার সমাধান চাইছে না বরং বিভক্ত হয়ে পড়ছে। একপক্ষ একদিকে তো অন্যপক্ষ অন্যদিকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, উইঘর মুসলমান নির্যাতন ইত্যাদি বহু বিষয়েই জাতিসংঘ এখনো কোনো সমাধান করতে পারছে না। কারণ এখানে দ্বন্দ্ব মূলত বিশ্বে আধিপত্য ধরে রাখার এবং বিস্তার করার। যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরেই পৃথিবীতে প্রায় একক আধিপত্য ধরে রেখেছে এবং চীন সেই পথে বর্তমান সময়ে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়া ও চীন এক বলয়ে অবস্থান করছে। পশ্চিমা জোট অন্যদিকে। চীনের বৈশ্বিক ক্ষমতায়নের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অনেকে বিষয়টিকে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বলছেন।

স্নায়ুযুদ্ধ যে বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর তা নিয়ে সতর্কবাণীও উচ্চারিত হয়েছে। বিশ্ব আগের চেয়ে আরো বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থানে যাচ্ছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই প্রতিযোগিতা যত না মানবিক তার চেয়ে বেশি অমানবিক। এখানে মানুষের ক্ষুধার কোনো মূল্য নেই। এখানে কেবল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। অস্ত্রই এখানে নির্ণায়ক। পৃথিবী থেকে মহাশূন্য সবজায়গাতেই চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। যেখানে সক্ষমতাই মুখ্য বিষয়। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চাঁদে পা রাখার পর থেকে প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ছাড়াও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও সামরিক প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীজুড়ে কাজ করছে প্রভাব বিস্তারের কৌশল এবং টিকে থাকা।

আজ সারা বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত রূপ দেখা দিয়েছে। কারণ অস্ত্রই ক্ষমতার উৎস বলে স্বীকৃত এবং পাওয়ার পলিটিক্সের প্রধান ধারক। অস্ত্র প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্যই হলো স্থল, আকাশ ও নৌপথে নিজের দেশকে সবার চেয়ে এগিয়ে রাখা। নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করা। অন্য দেশের ওপর খবরদারি করা। এশিয়ায় শক্তিমত্তা বাড়িয়ে চলেছে চীন ও ভারত। এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি মোকাবিলায় শিজিনপিংয়ের মেয়াদকালের শুরু থেকেই সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে শুরু করে চীন। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন যুক্তরাষ্ট্রকে চীনকে নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে চোখ রাঙাচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার। ক্রমশই পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকির দিকে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের মারাত্মক ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। যদি এই অস্ত্রের প্রয়োগ শুরু হয় তাহলে কোনোভাবেই বিশ্বকে ধ্বংস থেকে আটকানো যাবে না। জাতিসংঘকে এক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তবে কতটুকু সফল হবে তা আমাদের জানা নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি,জাতিসংঘের ভূমিকা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close