reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১০ জানুয়ারি, ২০২৪

ভালোবাসা না-কি মোহ!

কারো প্রতি ভালোলাগা, তার সাথে কথা বলতে চাওয়ার ইচ্ছা, তার থেকে কিছু শোনার ইচ্ছা, একটু দেখা করার প্রবল আগ্রহ অথবা ভালোলাগার মানুষকে নিয়ে সুন্দর চিন্তায় মগ্ন থাকার যে অনুভূতি হয় তা এক কথায় অসাধারণ।

এখন এসবই তো কারো প্রতি প্রেমে পড়ার লক্ষণ। কিন্তু আপনি কি আসলেও প্রেমে পড়েছেন? নাকি প্রেমই আপনার ওপর পড়েছে? সেটাই মুখ্য বিষয়।

অপনার পছন্;রে মানুষটিকে নিয়ে ভালোলাগা আপনার দৈনন্দিন কাজে কর্মে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কি-না সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। আর সেই ভালোলাগাটা কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে সেটা নিয়েও সন্দেহ থাকতে পারে।

আর মার্কিন মনোবিজ্ঞানি ডোরোথি টেনভ ক্ষণস্থায়ী এই মোহর নাম দিয়েছেন ‘লিমেরেন্স’।

লিমেরেন্স বলতে যা বোঝায়

মনোবিজ্ঞানী ডোরোথি টেনভ তিন’শরও বেশি সাক্ষাৎকার পরিচালনা করার পরে ১৯৭০ সালের দিকে মানুষ কীভাবে রোমান্টিক প্রেমের অভিজ্ঞতা অর্জন করে, সেটার ওপর একটি উপাত্ত সংগ্রহ করেন। সেখান থেকেই প্রথম ‘লিমেরেন্স’ শব্দটির নিয়ে এসেছিলেন।

সাক্ষাৎকারের সময় তিনি স্পষ্টতই খেয়াল করেন যে, প্রেমে পড়েছে এমন ব্যক্তিদের মাঝে বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল- তারা ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তির মনোযোগ ও আগ্রহের জন্য অনেক বেশি ব্যাকুল থাকেন।

১৯৭৯ সালে তার প্রকাশিত ‘লাভ অ্যান্ড লিমেরেন্স’ নামক বইয়ে এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

নিউ ইয়র্ক’য়ের ক্লিনিকাল সোশাল ওয়ার্ক/ থেরাপিস্ট মার্গারেট লরেঞ্জ এই বিষয়ে ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “লিমেরেন্স’ হল একটা উচ্চতর ক্রাশ, অনেকটা স্টেরয়েডের ক্রাশের মত।”

মার্কিন ক্লিনিক্যাল সোশাল ওয়ার্কার ব্র্যান্ডি ওয়েন্ট বলেন, “লিমেরেন্স’ বা মোহ হল এমন একটা অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি অন্যজন ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার, তার মনোযোগ পাওয়ার এবং ইতিবাচক অনুভূতি প্রতিদানে দেওয়ার অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। একে ‘লিমেরেন্ট অবজেক্ট’ বলা হয়।”

ওয়েন আরও বলেন, “মোহ মাঝে মধ্যে এমন আবেশী চিন্তাভাবনা এবং বাধ্যতামূলক আচরণের দিকে নিয়ে যায় যা দৈনন্দিন কার্যকারিতায় হস্তক্ষেপ করে।”

যেমন- দীর্ঘক্ষণ তার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা অথবা যতটা বেশি সময় সম্ভব তার সাথে সময় কাটানো, বারবার পছন্দের ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করা এবং মানসিকভাবে সেই ব্যক্তি প্রতি মিথস্ক্রিয়া স্থাপন যা সকল কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে।

লিমেরেন্স’য়ের লক্ষণসমূহ

‘লাভ অ্যান্ড লিমেরেন্স’য়ে ডা. টেনভ এই ধরনের অবস্থা চিহ্নিত করার কয়েকটি উপায়ের কথা বলেন

সম্পর্কে অনুপ্রবেশকারী চিন্তা।

অনুভূতির প্রতিদান দেওয়ার জন্য চরম আকাঙ্ক্ষা।

মন মেজাজ ও কাজকর্মে তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠা।

সেই ব্যক্তির কাছ থেকে প্রত্যাখ্যানের ভয় যা তার সামনে উপস্থিত হতে লজ্জার অনুভূতি সৃষ্টি করে

অনিশ্চয়তার ভয় যা থেকে বুকে ব্যথা সৃষ্টি হয়।

পছন্দের ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এমন কাজে তৎপর থাকা।

তিনিও একই রকম অনুভূতি অনুভব করছে কি-না সেই লক্ষণগুলো খুঁজে বের করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

এই তীব্র অনুভূতির ফলে জীবনের অন্যান্য বিষয়গুলো থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়া।

সেই পছন্দের ব্যক্তি একই রকম অনুভূতি প্রকাশ করছে- এরকম বুঝতে পারলে ‘বাতাসে ভাসছে’ ধরনের অনুভূত হওয়া।

নেতিবাচক চিন্তা কাটাতে তার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের ওপর জোর দেওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি।

যদিও লিমেরেন্স এবং ক্রাশের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও প্রথমটার মাত্রা অনেক বেশি।

মার্কিন ‘সেক্স অ্যান্ড রিলেশনশিপ থেরাপিস্ট’ মার্গারেট লরেন্স বলেন, “লিমেরেন্স’ একটি উচ্চতর ক্রাশ বা স্বল্পকাল স্থায়ী প্রেমেরভাব থেকেও বেশি কিছু যা অনেকটা স্টেরয়েডের ওপর ক্রাশ খাওয়ার মতো।”

তিনি আরও বলেন, “ক্রাশ’ হচ্ছে দ্রুতই বিবর্ণ হয়ে যায় এমন অনুভূতি। এটা দৈনন্দিন জীবনে কোনো বাধার সৃষ্টি করে না স্বাভাবিকভাবেই জীবন চলতে থাকে। তবে ‘লিমেরেন্স’ বিষয়টা কিছুটা ভিন্ন। এটা দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে।”

যেমন- সারাক্ষণ অন্য একজনের কথা ভাবা, তাকে নিয়ে দিবা স্বপ্ন দেখা, তার ফোন কল অথবা ম্যাসেজের জন্য অপেক্ষা করা, তার সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করতে চাওয়া। তাছাড়া এই যোগাযোগ এগিয়ে চললে এবং সে জীবনসঙ্গী হলে কেমন হবে সেই বিষয়ে কল্পনা করা ইত্যাদি।

ভালোবাসা ও লিমেরেন্স এর মধ্যে পার্থক্য

প্রেম ও লিমেরেন্স’য়েল মধ্যে মিল থাকায় অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে।

এই বিষয়ে ‘ডেটিং’ ভিত্তিক অ্যাপ ‘হাইলি’র সম্পর্ক বিষয়ক গবেষক মারিসা টি কোহেন বলেন, “মনে করতে পারেন ‘লিমেরেন্স’ হচ্ছে আবেগপ্রবণ ভালোবাসা অথবা সম্পূর্ণভাবে অন্য ব্যক্তির সাথে মিশে যাওয়ার প্রবণতা। আর সেটা ওই ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ না জেনেও তার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়েও ভালোবাসায় ডুবে যেতে পারে।”

দুইয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল অনিশ্চয়তা। পছন্দের ব্যক্তিটি যদি আপনার ইচ্ছার প্রাধান্য না দেয়, মানসিক প্রয়োজনের সময় পাশে না থাকে অথবা তার জীবনে এমন কিছু আছে যা তাকে আপনার দিকে মনোযোগ দেওয়ার অবসর বা সুযোগ কোনটাই দিচ্ছে না- তখন লিমেরেন্স এর উদ্ভব ঘটে।

ওয়েন্ট’য়ের মতে, “আকর্ষণ, ক্রাশ বা অন্যান্য বিষয় থে্কে লিমেরেন্স আলাদা করার মূল চাবিকাঠি হল পছন্দের ব্যক্তির অলভ্যতা।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “অনেক প্রতিবন্ধক বিষয় আছে যা একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গঠনে বাধা দেয়। যেমন- অসঙ্গতিপূর্ণ যৌন অভিযোজন বা লিঙ্গ পরিচয় অথবা বয়সের পার্থক্য, বা পছন্দের ব্যক্তিটি যদি ইতোমধ্যে অন্য কারও সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে থাকে অথবা সে যদি কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়।”

লিমেরেন্স মোকাবিলা করার উপায়

সর্বোত্তম পদ্ধতি হল, পছন্দের সেই ব্যক্তির সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন তার যাচাই করা।

“যদি তাকে আগে থেকেই চেনেন এবং তার জন্য আপনার অনুভূতি কাজ করে তবে তাকে জানানো প্রয়োজন। এতে করে ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক যে কোনো একটি অনুভূতি সম্পর্কে জানতে পারবেন”, পরামর্শ দেন লরেন্স।

পছন্দের ব্যক্তি না বাচক অথবা হ্যাঁ বাচক উত্তর আপনার মোহের ওপর কাজ করবে। এমনও হতে পারে যে, তার না বাচক উত্তরে আপনার মোহ কেটেও যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, “যদি এমন হয় যে- পছন্দের ব্যক্তির জন্য বন্ধুবান্ধবদের উড়িয়ে দিচ্ছেন, সবসময় তার কথা চিন্তা করছেন অথবা কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আট দিন আগে থেকেই ব্যতিব্যাস্ত হয়ে আছেন কিন্তু অপরপক্ষ থেকে তেমন সাড়া মিলছে না- সেক্ষেত্রে আমার ক্লায়েন্টদের তার বন্ধু বান্ধবদের সাথে মিশতে ও ঘোরাফেরার পরামর্শ দিয়ে থাকি।”

এক্ষেত্রে ‘কর্ড কাটিং’ ধ্যানের পরামর্শ দেন তিনি। এক্ষেত্রে এমন একজনকে কল্পনা করার কথা বলেন, যেখানে পছন্দের ব্যক্তি সাথে তার সংযুক্তি আছে। এরপর সে তার কেটে দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি ও কল্পনার মাধ্যমে তা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন, তিনি।

তিনি আরও বলেন, “কয়েক মাস ধরে এই ধারণা পোষণ করা যে, দুজনের মাঝখানে যে শক্তি আছে তা ফিরে যাচ্ছে বা শেষ হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। এই পদ্ধতি মোহ কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে।”

তবে কখনও কখনও এই মুহূর্ত এত বেশি তীব্র হয়ে উঠতে পারে যে সাধারণ সমাধানগুলো এক্ষেত্রে ভালো ফলাফল দেয় না। আবার অনেকে নিজেই এমন অনুভূতি থেকে বের হতে চায় না।

কারও যদি এমন অনুভূতি হয়ে থাকে তবে সেখান থেকে বের হতে অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তি বা পেশাদার সহায়তাকারীর সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন এই পরামর্শক।

জীবনে কোনো ‘ক্রাশ’ থাকা উত্তেজনাপূর্ণ হতে পারে। আকাঙ্ক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে।

অন্যদিকে মোহ বা ‘লিমেরেন্স’ যখন দেখা দেয় তখন তীব্রভাবে উচ্চ এবং নিম্ন হতে পারে যা ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনকে বিভ্রান্ত করে। সেক্ষেত্রে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভালোবাসা,না-কি মোহ!,লিমেরেন্স
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close