শাজাহানপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি
কর কর্মকর্তা তোহিদুলের সম্পদের পাহাড়
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার পলিপলাশ গ্রামে নামে-বেনামে শতাধিক বিঘা জমি কিনে মৎস্য ও গবাদিপশুর খামার এবং ড্রাগন বাগান গড়ে তুলেছেন কর কর্মকর্তা তোহিদুল ইসলাম ইকবাল।
এলাকাবাসী জানান, পলাতক আইজিপি বেনজীর আহমেদের মতো তিনিও নিজ গ্রামে একটি রিসোর্ট নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। এমনকি চায়না থেকে ইঞ্জিনিয়ার আনার পরিকল্পনাও ছিল। বিস্তীর্ণ এলাকা বেড়া দিয়ে ঘিরেও ফেলা হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয় ৫ আগস্টের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন।
বর্তমানে কর আপিল অঞ্চল, খুলনায় কর কমিশনার হিসেবে কর্মরত তোহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে বগুড়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তার প্রতিবেশী পলিপলাশ গ্রামের আবদুর রহমান গত ১৭ সেপ্টেম্বর লিখিত অভিযোগ করেন। তোহিদুলের ছোট ভাই আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে কবরস্থান দখল এবং ২০টি কবর উচ্ছেদের অভিযোগ রয়েছে থানায়।
- রিসোর্ট নির্মাণ ও খামারের জন্য শত বিঘা জমি ক্রয়
- সরকারি সড়ক ও কবরস্থান দখল, কর ফাঁকির অভিযোগ
- চাকরি জীবনে বেতন ২ কোটি টাকা, সম্পদ ২০ কোটি
দুদক বগুড়া জেলা কার্যালয়ে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, তোহিদুল ইসলাম ইকবালের বাবা প্রয়াত ইউনুছ আলী আকন্দ আওয়ামী লীগ করতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তোহিদুল ইসলামের বিত্ত-বৈভব বাড়তে থাকে। বগুড়ার শেরপুর উপাজেলার ঘোড়দৌড় মৌজায় সরকারি জমিতে পুকুর খনন, শাজাহানপুর উপজেলার নয়মাইল এবং নন্দীগ্রাম উপজেলায় জমি কেনাসহ বগুড়া ও ঢাকায় বিপুলসংখ্যক প্লট ও ফ্ল্যাট এবং অস্ট্রেলিয়ায় দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে বাড়ি কেনারও অভিযোগ করা হয়েছে দুদকে।
পলিপলাশ গ্রামে নিজের এবং ভাইদের নামে শতাধিক বিঘা জমি ক্রয়, কবরস্থান এবং সরকারি জায়গা দখল করে বড় বড় পুকুর খনন, ড্রাগন বাগান এবং ছাগল ও গরুর খামার গড়ে তুলেছেন তিনি।
কর কর্মকর্তা তোহিদুল ইসলামের ছোট ভাই আমিনুর রহমান জানান, ৪২ বিঘা জুড়ে গড়ে তোলা খামারের মধ্যে ৩৫ বিঘা তিনি কিনেছেন। বাদবাকি জমি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে দাবি করেন তিনি ঢাকায় স্টেশনারি ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসার টাকা দিয়ে ২০০৬ সাল থেকে ধীরে ধীরে জমি কিনেছেন এবং পরে ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খামারটি প্রতিষ্ঠা করছেন। এরপর তিনি তার খামারের নামে আমরুল ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেওয়া ট্রেড লাইসেন্স এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের শাজাহানপুর উপজেলা শাখা থেকে প্রায় দুই বছর আগে নেওয়া ১ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরিপত্রের ফটোকপি দেখান। খামারের পেছনে মোট কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ট্যাক্স ফাইল দেখুন। সেখানে সব উল্লেখ আছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আমিনুর রহমান ২০০৬ সাল থেকে ব্যবসার কথা বললেও তার আয়কর ফাইল খোলা হয় ২০১৪ সালে। তার নথি ঢাকায় কর অঞ্চল-৬-এর আওতাভুক্ত। ওই খামারে তার ভাই কর কর্মকর্তা তোহিদুল ইসলামেরও জমি রয়েছে। ভূমি অফিসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, পলিপলাশ গ্রামে (মৌজা : নগরকান্দি) তোহিদুল ইসলামের নামে কেনা জমির নামজারির মাধ্যমে মোট ১৮টি হোল্ডিং খোলা হয়েছে।
এর মধ্যে একটির হোল্ডিং স্থগিত রয়েছে। অন্য ১৭টি হোল্ডিংয়ের জমির পরিমাণ ১৬ দশমিক ৭০ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ৮৯ একর জমি রয়েছে ৪৯৬৯নং হোল্ডিংয়ে। এরপর ২ দশমিক ৮৪ একর ও ২ দশমিক ৮২ একর করে জমি রয়েছে যথাক্রমে ৫৩৭৯ ও ৫৩৮০নং হোল্ডিংয়ে। এ ছাড়া তার নামে ৫৪৯৯নং হোল্ডিংয়ে ১ দশমিক ৬৬ একর, ৫০২৬নং হোল্ডিংয়ে ১ দশমিক ৬৫ একর, ৫০২৫নং হোল্ডিংয়ে ৮৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ জমি, ৫৩৬২নং হোল্ডিংয়ে ৬৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, ৫০৪৬নং হোল্ডিংয়ে ৬০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, ৫২১৩নং হোল্ডিংয়ে ৫৪ দশমিক ২৫ শতাংশ, ৫৪৮২নং হোল্ডিংয়ে ৪২ শতাংশ, ৫৩৭০ নং হোল্ডিংয়ে ৩৬ শতাংশ, ৫১৪৩নং হোল্ডিংয়ে ৩২ শতাংশ, ৫২৩৩নং হোল্ডিংয়ে ২৯ শতাংশ, ৫০৮৯নং হোল্ডিংয়ে ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ৫১৮৯নং হোল্ডিংয়ে ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৫৩৮৭নং হোল্ডিংয়ে ২২ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও ৫২২১নং হোল্ডিংয়ে ৮ শতাংশ জমি রয়েছে। একই মৌজায় কর কর্মকর্তা তোহিদুল ইসলামের ভাই আমিনুর রহমানের নামে ২১টি হোল্ডিংয়ে মোট ১৩ দশমিক ৭২ একর জমি রয়েছে।
এ ছাড়া তোহিদুল ইসলাম এবং তার ভাই আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে কবরস্থান থেকে ২০টি কবর উচ্ছেদের অভিযোগ করেছেন পলিপলাশ গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহমান। শাজাহানপুর থানায় দাখিল করা সেই অভিযোগে তিনি বলেছেন, নগরকান্দি মৌজায় আরএসের ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬নং খতিয়ানভুক্ত ১৬৫১৮, ১৬৫১৪ এবং ১৬৫৩৯ দাগের ৫ শতাংশ জমি তিনি এবং তার ভাই পৈতৃক এবং ক্রয় সূত্রে মালিক ছিলেন। যা পারিবারিক কবরস্থান ছিল এবং সেখানে ২০টি কবর ছিল। কর কর্মকর্তা তোহিদুল ইসলাম এবং তার ভাই আমিনুর রহমান প্রথমে জোরপূর্বক কবরস্থানের ওই জমি দখল করে নেন। কবরস্থান ফেরত চাইতে গেলে বিভিন্ন সময় গালিগালাজ করেন এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। চলতি বছরের ২০ আগস্ট সকাল ১০টায় তারা কবরস্থান থেকে কবরগুলো তোলার পর মাটিগুলো সরিয়ে চারদিকে তারকাঁটা দিয়ে বেড়া দেয়।
আবদুর রহমান অভিযোগ করেন, তোহিদুল ইসলাম ইকবাল ওই গ্রামে ২৪ বিঘা জায়গা নিয়ে পুকুর খনন করতে গিয়ে পলিপলাশ পশ্চিম বাজার থেকে হরিণার বিলমুখী সরকারি সড়ককের জায়গা দখল করেন। ফলে ওই সড়কটি দিয়ে মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তাদের ওয়ারিশদের কাছ থেকে তোহিদুল ইসলাম ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬৫১৩, ১৬১৫৪ ও ১৬৫১৮ দাগ নম্বরের যে সোয়া ৬ শতাংশ জমি কিনেছেন সেগুলোর কোনোটিই বাগান ছিল না। এর মধ্যে ১৬৫১৩ দাগ নম্বরের জমির শ্রেণি ছিল ভিটা। আর অপর দুই দাগ নম্বরের জমির শ্রেণি হলো বাঁশঝাড়। কিন্তু তোহিদুল ইসলাম কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য ওই জমিগুলোকে দলিলে ‘বাগান’ দেখিয়ে কর ফাঁকি দিয়েছেন। আবদুর রহমানের দাবি ১৫তম ব্যাচের কর কর্মকর্তা তোহিদুল ইসলাম ইকবাল চাকরি জীবনে এখন পর্যন্ত সর্ব সাকুল্যে বেতন পেয়েছেন ২ কোটি টাকা। অথচ শুধু আমাদের গ্রামেই ২০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ গড়েছেন।
তোহিদুল ইসলাম আমরুল ইউনিয়ন পরিষদের যে ওয়ার্ডের বাসিন্দা সেই ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম জানান, মূলত ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এসব জমি কেনা শুরু হয়। দূর সম্পর্কের এক ভাগনের সঙ্গে এই কর কর্মকর্তা গাজীপুরে অনেক জায়গা-জমি কিনেছেন। সংরক্ষিত মহিলা সদস্য সুমি আকতার জানান, এই গ্রামের সবাই জানে জমিগুলো কর কমিশনার ইকবাল সাহেব কিনেছেন। যেগুলো ধানি সেগুলো প্রতি শতাংশ জমি ৫০ হাজার টাকা করে কিনেছেন বলেই শুনেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি জানিয়েছেন, ইকবাল সাহেব তার এক স্বজনের কাছ থেকে এক দাগে অনেক ১৫ বিঘারও বেশি জমি কিনেছেন। জমির মূল্য পরিশোধের সময় নগদে তিনি টাকার যেসব নোট দিয়েছেন তা দেখে বোঝা যায় সেগুলো কোথাও স্তূপ করে রাখা ছিল। কারণ নোটগুলো অগোছাল বা এলোমেলো ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক জানিয়েছেন, এক রাতে ট্রাকভর্তি বস্তা ফার্মে আনা হয়। তখন তাদের বস্তাগুলো নামাতে বলা হয়। ওই শ্রমিক বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম বস্তায় হাঁস-মুরগির ফিড (খাদ্য) রয়েছে। কিন্তু সেগুলো নামাতে গিয়ে মনে হয়েছে বস্তায় ফিড নয় টাকার বান্ডিল ছিল।’ খামারের জমির জন্য ইউনিয়ন পরিষদে কোনো ট্যাক্স না দেওয়ার অভিযোগ করেছেন আমরুল ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তারা। তারা জানান, শুধু ভিলেজ অর্গানিক এগ্রো খামার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতি বছর ২০০ টাকা দিয়ে তারা ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করেন। এটা অন্যায়। কিন্তু আমরা কিছু বলতে পারি না। কারণ তারা প্রভাবশালী।
‘ভিলেজ অর্গানিক এগ্রো খামার’-এর বিপরীতে ১ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের শাজাহানপুর শাখার ব্যবস্থাপক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘২০২২ সালের অক্টোবরে যখন এই ঋণ দেওয়া হয় তখন আমি এই শাখায় ছিলাম না। তবে শুনেছি যে, তাদের (আমিনুর রহমান) কোনো ঋণের প্রয়োজন ছিল না। বড় খামার দেখে আমাদের সিনিয়র অফিসাররাই সেখানে ঋণ দিয়েছেন।’
কবর স্থানের জায়গা দখল এবং কবর উচ্ছেদের বিষয়ে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা শাজাহানপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর সমর সাংবাদিকদের বলেন, ‘তদন্তকালে বিবাদী পক্ষ আমার কাছে দাবি করেছেন যে কবরস্থানের জায়গা আলাদা আর অভিযোগকারীর বর্ণিত জায়গা আলাদা। তবে সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেখা গেছে। এ নিয়ে দুই পক্ষকে বসার জন্য বলেছি।’
অভিযোগের বিষয়ে কর কর্মকর্তা তোহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুদক যদি তদন্ত করে প্রমাণ পায় তাহলে ব্যবস্থা নেবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই।’ দুদক বগুড়া জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কর কর্মকর্তা তোহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগটি পাওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী তদন্তের অনুমতি চেয়ে তা প্রধান কার্যালয় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অনুমতি পেলে তদন্ত শুরু করা হবে।’