মো: জামাল হোসেন, বেনাপোল
বেনাপোল-খুলনা-ঢাকা রুটে প্রতিদিন পাচার হয় লাখ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য
চলছে তীব্র গরম। আর এই গরমে প্রতিদিন শত শত শীতের কম্বল, বিভিন চকলেট, প্রসাধনী দ্রব্যাদি সীমান্তের অবৈধ পথে চোরাকারবারিরা নিয়ে আসছে বেনাপোল চেকপোস্ট এলাকা থেকে। পরে এসব পণ্য যশোর, খুলনা, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর ও খুলনা থেকে আসা শতাধিক নারী পুরুষ মহিলা চোরাকারবারিরা বেনাপোল-খুলনা-মোংলাগামী কমিউটার ট্রেন ‘বেতনা এক্সপ্রেস’ ও বেনাপোল-ঢাকাগামী ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’ এ করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে।
প্রতিদিনের দৃশ্য এটা বেনাপোল রেলস্টেশনে। রেল পুলিশ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী, আনসার সদস্য ও থানা পুলিশের আদায়কারী দালালের সহযোগিতায় প্রতিদিন এ কারবার চলছে। আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের চোখের সামনে এ ব্যবসা চললেও তারা এ ব্যাপারে নিরব ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব ট্রেনে কোন তল্লাশি চালানো হয় না। যাত্রীদের সামনেই চোরাচালানীদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে টাকা নিতে দেখা যায় এ সব বাহিনীর লোকদের। মাঝে মধ্যে বিজিবি সদস্যরা এসে ঘুরে ফিরে চলে যায়।
সড়ক পথে বেনাপোল চেকপোস্ট সীমান্ত পার হলে ঢাকা-বেনাপোল সড়কের আমড়াখালি নামক স্থানে বিজিবি চেকপোস্ট, বেনাপোল বন্দর থানা, নাভারণ হাইওয়ে ফাঁড়ি, শার্শা থানা, ঝিকরগাছা থানা অতিক্রম করা ঝুঁকিপুর্ণ। অথচ ট্রেনের চোরাই পণ্য পরিবহন অনেক সহজ লভ্য ও খরচ কম। বেনাপোল থেকে যশোর, খুলনা আর কোথাও বাধা নেই, নেই কোথাও বিজিবি বা পুলিশ। তাই অধিকাংশ চোরাকারবারিরা বেনাপোল থেকে ছেড়ে যাওয়া বেতনা ও বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন দুইটিকে তাদের মালামাল পাচারের নিরাপদ বাহন হিসাবে ব্যবহার করছে। ট্রেনের মধ্যে দায়িত্বে নিয়োজিত রেলওয়ে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট হারে টাকা পেয়ে এসব চোরাকারবারি পণ্যকে বৈধ্যতা দিচ্ছে। আর নির্দিষ্ট থানা পার হতে চোরাকারবারিরা থানার দালালদের দিচ্ছে টুপলা প্রতি একটি অংকের টাকা। যখনি কোন চোরকারবারি এসব দালালদের টাকা দিতে অস্বীকার করেন তখনি দালাল ও চোরাকারবারিদের মাঝে তুলকালাম শুরু হয়। অকথ্য ভাষায় চলে চোরকারবারি মহিলাদের গালিগালাজ। যা যাত্রীরা শুনে মুখে কাপড় দিয়ে মুখ লুকানোর চেষ্টা করে। এভাবেই চলছে বেনাপোল থেকে খুলনাগামী ও ঢাকাগামী ট্রেনের যাত্রী সেবা।
বেতনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্রতিদিন বেনাপোল থেকে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে ও বিকেল ৫টায় দুইবার যাওয়া আসা করে থাকে। আর বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুপুর একটায় ছেড়ে যায় বেনাপোল থেকে। এসব ট্রেনে কম্বল এর সাথে মাদক, থ্রি-পিস, চকলেট, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রসাধনী সামগ্রী, ইমিটেশন গহনা, সিগারেট, মোবাইল, কাপড়, কিসমিস, নিম্নমানের চা পাতা, আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধসহ বড় বড় চালান নির্বিঘ্নে নিয়ে যাচ্ছে যশোর খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে। যার ফলে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব। এসব পণ্য আগে বৈধ পথে আমদানি হয়ে আসলেও এখন সবই আসছে চোরাই পথে।
নতুন করে গজিয়ে উঠা বেনাপোল চেকপোস্ট এলাকার বিভিন্ন দোকানসহ আশেপাশের গ্রামে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। সকালের ট্রেনে শত শত মহিলা চোরাকারবারি চলে আসে বেনাপোল রেলস্টেশনে। সেখানে নেমে ইজিবাইকে করে চলে যায় চেকপোস্টসহ বিভিন্ন এলাকায়। সেখান থেকে চোরাই মালামাল কিনে আবরো ইজিবাইক ভর্তি করে মাল নিয়ে আসে রেলস্টেশনে। ট্রেন আসার সাথে সাথে ট্রেনের বিভিন্ন বগিতে তোলা হয় এসব পণ্য। সাধারন যাত্রীরা টিকিট কেটে সিটে বসতে পারে না। ট্রেনের বাংকার। সীটের নীচে, এমনকি সীটের ওপরে রেখে দেয় এ সব মালামাল। তবে সব থেকে ভারতীয় কম্বল বেশি আসে। প্রতিদিন কয়েক হাজার পিস ভারতীয় কম্বল চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য খুলনা থেকে ট্রেনে আসা ৮/১০ রেলওয়ে পুলিশ প্রতিটি ট্রেনের বগিতে থাকার কথা থাকলেও তারা ২টি বগিতে ট্রেনের মধ্যে সিট নিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আসা যাওয়া করে থাকে। কোন যাত্রীদের নিরাপত্তা দেয়া দুরে থাক যাত্রীরা বিপদে পড়লেও এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে চোরাচালানিদের ব্যাগ তল্লাশি না করে ভাল যাত্রীদের ব্যাগপত্র তল্লাশী করতে দেখা যায়। ট্রেন দুইটিতে যাত্রীদের কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি এখনো পর্যন্ত। পক্ষান্তরে চোরাকারবারিদের পাচারকারী বাহান হিসেবে বহুলাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ট্রেনটিতে মাঝে মধ্যে সাধারণ যাত্রীরা চোরাকারবারিদের দ্বারা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
ট্রেনে আসা সাধারন যাত্রীরা জানায়, যশোর খুলনায় যেতে বাসের চেয়ে ট্রেনের ভাড়া অনেক কম বলে ট্রেন যাত্রাকে অনেকটা পছন্দ করেন। কিন্তু একবার যদি কোন সাধারন যাত্রী এ ট্রেনে উঠে তা হলে সে আর দ্বিতীয় বার চোরাচালানিদের সিট দখল করে চোরাই পণ্য রাখা ট্রেনে করে দাঁড়িয়ে যশোর, খুলনায় যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এসব চোরাচালানীদের ট্রেনের টিকিটও কাটা লাগে না। এই দুইটি ট্রেন এখন চোরাচালানীদের নিরাপদ চলাচলের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহিলা চোরাচালানীরাই মূলত এই ট্রেন দুইটি বেশি ব্যবহার করছে। ট্রেনের মধ্যে চোরাচালানী মালামাল রাখায় হাটাচলাও করা যায় না। আবার ট্রেনের মধ্যে চোরাচালানীদের খোশ গল্পের সাথে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারে যাত্রীরা চরম বিড়ম্বনায় পড়েন। এর ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে এ দুটি ট্রেনের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রান চান তারা। ট্রেনে এসে রোগীরা হয়ে পড়ছেন অসুস্থ। পাচ্ছেনা কাঙ্খিত সেবা।
বেনাপোল থেকে যশোর যাওয়াতকারী রেল যাত্রী আনারুল ইসলাম জানান, আমি প্রতিদিন ব্যবসার কাজে যশোর থেকে বেনাপোল যাতায়াত করে থাকি। আসা যাওয়ার পথে যে ভাবে মহিলা চোরাচালানীরা ভারতীয় কম্বলসহ অন্যান্য মালামাল নিয়ে ওঠে তা কল্পনা করা যায় না। আগে এসব মালামাল আমদানি করে আনা হতো। সরকারও রাজস্ব পেতো। সরকার এসব মালামালের মূল্য ও ডিউটি বাড়িয়ে দেওয়ায় চোরাই পথে আসছে। এতে সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর হলে চোরকারবারিদের তৎপরতা কমবে বলে তিনি জানান।
বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার সাইদুজ্জামান জানান, আমরা যাত্রীদের ভালো সেবা দিতে কাজ করছি। চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য রেল পুলিশ রয়েছে। এটা তাদের কাজ।
এ ব্যাপারে বেনাপোল রেলওয়ে ফাঁড়ির দায়িত্বে নিয়োজিত এসআই মনিরুল ইসলাম জানান, রেলওয়ের যাত্রীদের নিরাপত্তাসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষ, রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফিটসহ রেলের সকল স্থাপনায় সংঘটিত অপরাধ বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশ দেখভাল করে থাকে। রেলে মহিলা চোরাচালানী বন্ধে অনেক কৌশল নিলেও তাদের অসহায়ত্বার কাছে কিছুটা নমনীয় হতে হয়। তারপরও ট্রেনে অভিযান চালানো হচ্ছে। চোরাচালানরোধে রেল পুলিশকে সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছে।
বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাসেল মিয়া জানান, রেলের দায়িত্বে রয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। সে কারণে সেখানে থানা পুলিশের কোন ভুমিকা নেই। তবে গোপন তথ্য পেলে অভিযান চালানো হয়ে থাকে।
পিডিএস/এমএইউ