বিবিসি

  ২১ অক্টোবর, ২০২৪

এএসপিদের কুচকাওয়াজ স্থগিত

আলোচনায় নেপথ্যের কারণ

শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ হঠাৎ স্থগিতের ঘটনা নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গতকাল রবিবার রাজশাহীর পুলিশ একাডেমিতে এ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পুলিশ সদর দপ্তর কুচকাওয়াজ স্থগিত হওয়ার বিস্তারিত কোনো কারণ উল্লেখ না করে বাহিনীর মুখপাত্র শুধু বলেছেন ‘অনিবার্য কারণে’ এটি স্থগিত করা হয়েছে। এই কুচকাওয়াজে যোগ দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাজশাহী পৌঁছান।

তবে, এই কুচকাওয়াজ স্থগিত হওয়ার ফলে ৪০তম বিসিএসে মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারের জন্য নির্বাচিত ৬২ জন এএসপির চাকরিতে যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। এদিকে, এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ওই ৬২ জনকে ‘ছাত্রলীগের ক্যাডার’ উল্লেখ করে ওই অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন। এরপরই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। মূলত এ কারণেই শনিবার রাতে অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই কুচকাওয়াজটি স্থগিত ঘোষণা করা হয় বলে অনেকে মনে করেন।

যদিও দুটি বিষয়ের মধ্যে আদৌ যোগসূত্র আছে কি না কর্তৃপক্ষের তরফে তা কেউ নিশ্চিত করেনি। পুলিশের একজন সাবেক আইজিপি বলেছেন, কুচকাওয়াজ স্থগিতের ঘটনাটি বেআইনি না হলেও, ‘অনেকটা নজিরবিহীন’। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেছেন, এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার, নতজানু আচরণ এবং সক্ষমতার অভাব প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। তাদের উচিত ছিল আগেই বিষয়টি রিভিউ করা, যাতে রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে কেউ ভিকটিমও না হয়, আবার সুবিধাও না পায়। এখনো উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে রিভিউ করে দেখা এবং খেয়াল রাখতে হবে যোগ্য কেউ যেন ভিকটিম না হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলছেন ঢালাওভাবে পুরো একটি ব্যাচের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নেয়াটা ‘সুবিবেচনাপ্রসূত’ নয়। কেউ যদি রাজনৈতিক পরিচয় বা সুবিধা নিয়ে কোনো ফেভার পায় কিংবা প্রশ্ন পেয়ে চাকরি পায়, সেটি যথাযথ তদন্তে প্রমাণিত হলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে একটি ব্যাচকে রাজনৈতিক তকমা দেওয়াটা যৌক্তিক হতে পারে না।

সরকারি কর্মকমিশন বা পিএসসি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৪০তম বিসিএস পরীক্ষা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। এরপর প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাসহ যাচাই বাছাইয়ের সব ধাপ শেষে ২০২২ সালের নভেম্বরে নির্বাচিত প্রার্থীদের গেজেট প্রকাশ করেছিল সরকার। ওই গেজেট অনুযায়ী তখন ৭১ জনের সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগদানের কথা। যাদের মধ্যে ৬২ জন দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে গতকাল পুলিশ একাডেমির প্যারেড গ্রাউন্ডে সমাপনী কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার কথা ছিল।

দুদিনের সফরে রাজশাহীতে থাকা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। পুলিশের অন্য কর্মকর্তারাও রাজশাহীর সারদা পুলিশে একাডেমিতে পৌঁছেন।

এর মধ্যেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকা নবীন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, যার সূচনা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কের একটি পোস্টের মাধ্যমে। তাকেও ওই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে পুলিশের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

রাত ১০টায় ওই পোস্টে তিনি বলেন, ‘..... এই ৬২ জন এএসপি হাসিনার আমলে নির্বাচিত হয়েছে। আর কত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিসিএস (পুলিশ)-এ নিয়োগ হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যক্তি আমার জায়গা থেকে তাই উক্ত প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার পক্ষপাতী নই। তাদের ব্যাপারে তদন্ত হয়েছে কি না....’

নিজের পোস্টে নিজেই আবার কমেন্ট করে তিনি লিখেন, ‘আওয়ামী লীগ শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত (৪০তম বিসিএসে) ৬২ জন ছাত্রলীগের ক্যাডার এএসপি হিসেবে রবিবার (গতকাল) প্রশিক্ষণ সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করতে যাচ্ছেন।’

এরপরই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলে রাতেই রবিবারের কুচকাওয়াজ স্থগিত করার কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানানো হয়। যদিও পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এনামুল হক সাগর বলেছেন, অনুষ্ঠানটি ‘অনিবার্য কারণবশত’ স্থগিত করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকেও একই বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।

সারদায় পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণার্থী সহকারী পুলিশ সুপারদের পুরো ব্যাচের কুচকাওয়াজ স্থগিতের ঘটনা অনেকটাই নজিরবিহীন বলছেন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাদের কয়েকজন। পুলিশের সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেছেন, এটি আইনবহির্ভূত না হলেও একটু ‘অস্বাভাবিক ও কিছুটা নজিরবিহীন’। তিনি বলছেন প্রশিক্ষণকালে কারো আচরণ যথাযথ না হলে তাকে সরাসরি বাদ দেওয়ার এখতিয়ারও কর্তৃপক্ষের আছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ শেষ করেও আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন সময়ে পাঁচশর বেশি এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছিলেন। তাদের বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আগেও বিভিন্ন সময় প্রার্থীর কিংবা তার আত্মীয়-স্বজনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা দেখিয়ে অনেককে চাকরিতে চূড়ান্ত নিয়োগ থেকে বঞ্চিত বা চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। এখনো সেই ধারা চলমান থাকলে তা হবে দুঃখজনক। কেউ যদি রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদে পরীক্ষায় সুবিধা পেয়ে চাকরি পেয়ে থাকেন, প্রমাণসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে যৌক্তিক। কিন্তু সবাইকে রাজনৈতিক তকমা দিয়ে চাকরিতে যোগদান থেকে বঞ্চিত করাটা সঠিক হবে না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close