হামিদুর রহমান, মাবপুর (হবিগঞ্জ)

  ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪

সুমনের জয়ের নেপথ্যে কী

হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনে প্রভাবশালী সংসদ সদস্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুব আলীকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে চমক দেখিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক (ব্যারিস্টার সুমন)। সুমনের এমন বিজয় নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা, খোঁজা হচ্ছে এর নেপথ্য কারণ। সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের প্রতীক ছিল ঈগল। এ প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাহবুব আলী পান ৬৯ হাজার ৫৪৩ ভোট। অর্থাৎ, দুজনের ভোটের ব্যবধান প্রায় এক লাখ।

প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর বাড়ি মাধবপুর উপজেলার বুল্লা ইউনিয়নের বানেশ্বর গ্রামে। তিনি ২০১৪ সাল থেকে টানা দুবারের সংসদ সদস্য। এবারও দল তাকে নৌকার মনোনয়ন দেয়। তার শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে মাঠে ছিলেন যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ সায়েদুল হক। তিনি এলাকায় ‘ব্যারিস্টার সুমন’ নামে পরিচিত। তার বাড়ি চুনারুঘাট উপজেলার বড়াইল গ্রামে। তিনি ছাত্রলীগের পরে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দল থেকে মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে এবার তিনি ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

সুমনের কাছে প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর ধরাশায়ী হওয়ার কারণ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই খোলামেলাভাবে ভেতরের কথা বলেন। আবার কয়েকজন সরাসরি কথা বলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতাকর্মীরা জানান, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের নেপথ্যেও অন্যতম কারণ দলের ভেতরের নীরব কোন্দল। এর সূত্রপাত গত উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে। এসব নির্বাচনে দলের অনেক ত্যাগী নেতা মনোনয়ন পাননি, পেয়েছিলেন অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয়, কম অপরিচিত ও দুর্বল প্রার্থী। ফলাফল হিসেবে তারা পরাজিত হন। সেখান থেকেই শুরু নীরব কোন্দল।

মন্ত্রী এলাকায় আসতেন কম। এছাড়া নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করা, মন্ত্রীর এপিএস ও তার বাবার কর্মকাণ্ডে মানুষের অসন্তুষ্টি, উন্নয়ন বঞ্চনার ক্ষোভ থেকে মানুষ সুমনকে বেছে নেয়। এর প্রভাব পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। দলের পদধারী নেতারা প্রকাশ্যে নৌকার পক্ষে থাকলেও ভেতরে ভেতরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। পাশাপাশি চা-বাগানের ভোটাররা এবার নৌকা থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। ব্যারিস্টার সুমন চা-শ্রমিকদের ভোটের পাশাপাশি এলাকার তরুণ সমাজ ও নতুন ভোটারদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। নৌকা প্রতীকের হারের পেছনে এগুলোই মূল কারণ বলে জানান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান বলেন, প্রতিমন্ত্রী ১০ বছর ধরে এ আসনের সংসদ সদস্য। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এটাই তার পরাজয়ের মূল কারণ। পাশাপাশি সুমন তরুণ ভোটারদের কাছে টানতে পেরেছেন।

২৩টি চা-বাগান নিয়ে গঠিত লস্করপুর ভ্যালির সভাপতি ও বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক রবীন্দ্র গৌড় কৌতুক করে বলেন, কোরমা-পোলাও খেতে অভ্যস্ত চা-শ্রমিকরা এবার ডাল-ভাত বেছে নিয়েছে।

চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ওপরে ওপরে প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে কাজ করলেও ভেতরে-ভেতরে তারা কেউই নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি।

মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মাধবপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র শাহ মোহাম্মদ মুসলিম, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বহরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন, জগদীশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মাসুদ খান, শাহজাহানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাবুল হোসেন খান, শাহজাহানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী, চৌমুহনী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ সৈয়দ হাবিবুল্লাহ সুচন, আতাউর রহমান সেলিম চৌধুরী, সাবেক ছাত্রনেতা মিজানুর রহমান দুলু, আবদুল ওয়াহিদ, আ. রশিদ মেম্বার, ফরাস উদ্দিন মাস্টার, মাধবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আতাউস সামাদ, চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রজব আলীসহ অসংখ্য নেতাকর্মী সায়েদুল হক সুমনের পক্ষে কাজ করেছেন।

এ বিষয়ে মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন বলেন, সাধারণ মানুষতো দূরের কথা প্রতিমন্ত্রীকে দলের নেতাকর্মীরাই কাছে পাননি। দলীয় লোকজন বা এলাকার কেউ তার কাছে গেলে তিনি তার ব্যক্তিগত সহকারী মোছাব্বির হোসেন ওরফে বেলালকে দেখিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেন। এ ছাড়াও তিনি জনবিচ্ছিন্ন ও বিতর্কিত লোকজনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাই দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী ক্ষোভ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী সায়েদুল হকের জন্য কাজ করেন।

সায়েদুল হক সুমন বিজয়ের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এলাকার সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি তরুণ ও চা-শ্রমিকদের ভোট আমি পেয়েছি। এ বিজয় সত্যিই আনন্দের। তবে এ অর্জনই শেষ নয়। আমার বড় দায়িত্ব মানুষের জন্য কাজ করা। আমি এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে দুটি উপজেলার আট লাখ মানুষের দায়িত্ব নিয়েছি। এখন তাদের পরামর্শে এলাকার উন্নয়নে কাজ করাই মূল উদ্দেশ্য। কাজেই মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়েই আমাকে সামনে চলতে হবে।’

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর সঙ্গে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ সায়েদুল হক পেয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোট।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close