ঐতিহাসিক এক রায়ে বহুল আলোচিত বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পেল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণার রিভিউয়ের আবেদন নিষ্পত্তি করে দিয়ে গতকাল রবিবার এ রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদ অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এ রায়ের মাধ্যমে এখন থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা বহাল রেখে সংবিধানের এ-সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ পুরোটাই পুনর্বহাল করেছেন আপিল বিভাগ। এ রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতিকে নিয়ে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন। পরে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৮ পর্যন্ত বিধান ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যম বাতিল করা হয়েছিল। এগুলো পুনর্বহাল করেছেন আপিল বিভাগ।

দেশের প্রথম সংবিধানে সংসদের হাতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রাখা হয়। তবে ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আবারও পঞ্চম সংশোধনীতে বিচারক অপসারণে নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। এরপর পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ সংশোধনী পর্যন্ত বিচারপতি অপসারণ নিয়ে আর নতুন কোনো সংশোধনী আসেনি। তবে ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় জাতীয় সংসদ। সে বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে পাস হয়। পরে এর বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন ৯ আইনজীবী। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। একই বছরের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৭ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করে রায় দেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এর রিভিউতে যায়।

আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সিনহা তার লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ে তার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সরকারের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও দলটির সমর্থক আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন। একপর্যায়ে বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যান। তাকে অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও তখন আলোচনা ছিল। যদিও ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি বিব্রত। পরে অবশ্য বিদেশে থাকা অবস্থায়ই তিনি পদত্যাগ করেন। আর দেশে ফেরেননি।

ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর পরিবর্তিতত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সম্প্রতি সাবেক সরকারের দোসর আখ্যা দিয়ে কয়েকজন বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরই জেরে গত সপ্তাহে চিহ্নিত ১২ বিচারপতিকে বিচারিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়। তাদের অপসারণের দাবির মুখে ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানির বিষয়টি ওঠে আসে। এ শুনানির নির্ধারিত দিন ছিল ২০ অক্টোবর। নির্ধারিত দিনে রিভিউ আবেদনের শুনানি শুরু হয় গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। অবশেষে বহুল আলোচিত বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে দেওয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করায় ক্ষমতা ফিরে পেল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

"