নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

অভিমত বিশেষজ্ঞদের

অপরিকল্পিত নগরায়ণে তীব্র তাপপ্রবাহ

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় এ সময় জনজীবনে অস্বস্তি বাড়তে পারে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দুর্ভোগ এড়াতে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

তথ্য বলছে, বিশ্বের শীর্ষ যে সব জনবহুল শহর রয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। মানুষের বাড়তি চাপের চাহিদা মেটাতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন ও অবকাঠামোর চাপ স্বাভাবিকভাবে গরমের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। এ বাড়তি চাপ সামলাতে পর্যাপ্ত জলাশয় ও গাছপালা নেই। ফলে ‘জল-সবুজের’ ঢাকা এখন শুধুই কংক্রিটের ঢাকায় পরিণত হয়েছে। গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের ‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শিরোনামে এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা মহানগরে ২০ শতাংশ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পার্ক উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা উন্নয়নের নামে ঢাকা শহরের বহু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও ঢাকা শহরে প্রচুর গাছ কাটা পড়েছে। অথচ রাজধানী শহরসহ সারা দেশে যে তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, ছায়া দেওয়ার মাধ্যমে তা থেকে সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ গাছ। গাছের পাশাপাশি জলাধারও গরমের কষ্ট লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ঢাকা শহরে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত গাছ ও জলাশয় না থাকায় মানুষের কষ্ট এখন চরমে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, ঢাকা শহরে এ গাছ ও জলাশয় ধ্বংস করে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনা হয়েছে। অসহ্য গরম থেকে রক্ষায় ছাদবাগান থেকে শুরু করে কোথাও গাছ লাগানোর জায়গা থাকলে ঢাকাবাসীকে তা করতে হবে। সে সঙ্গে গাছ লাগানো ও জলাশয় উদ্ধারের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ, আবহাওয়াবিদ এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার এমন বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। যার ফলে বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন প্রধান ভূমিকা রাখছে। সেইসঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশে তাপমাত্রার এমন বৈরী আচরণের জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। দেশি এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু ঢাকায়ই বছরে অসহনীয় গরম দিনের সংখ্যা গত ছয় দশকে অন্তত তিনগুণ বেড়েছে।

আবহাওয়া ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, তাপমাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধির প্রধান কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। এজন্য অবশ্য উন্নত বিশ্বের বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই দায়ী করা হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বৈশ্বিক কারণ ছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিবেশের অযৌক্তিক ক্ষতি করাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ আদিল খান সংবাদমাধ্যমে বলেন, এখন ভবনগুলোর ডিজাইনই হচ্ছে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রেখে কিংবা শীতাতপ যন্ত্র যাতে বসানো যায়, সে চিন্তা করে। অথচ আগে অনেক ভবন এমনভাবে করা হয়েছে- যাতে গরমকালে শুধু ফ্যানেই কাজ হতো।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে জলবায়ু নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে; বিশেষ করে মেট্রোরেলের মতো বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহন বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণ করতেই হবে। খাল-পুকুর সব ভরাট হয়ে গেছে। জলাধার নেই। এগুলোই তো সাময়িকভাবে তাপমাত্রা কমাতে দরকার হয়।’ তবে নগরায়ণের পাশাপাশি শহরগুলোকে কীভাবে আরো বেশি পরিবেশবান্ধব করা যায়, সে পরিকল্পনার ওপর জোর দেওয়ারও আহ্বান বিশেষজ্ঞদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মো. শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণ বাড়বে। কিন্তু শহরগুলোকে একটি মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় এনে, গ্রিনারি বা সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। শহরগুলোর জনসংখ্যা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। শহরের সুবিধাগুলোকে শহরের বাইরে ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে জনসংখ্যায় ঘনত্ব কমাতে হবে। পাশাপাশি ভবনগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে। কংক্রিটের পরিমাণ কমিয়ে বনায়ন বাড়ানোর প্রতি সবচেয়ে জোর দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।’

এ বিষয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ আদিল খান বলেন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কংক্রিটের পরিমাণ কমাতে হবে এবং বনায়ন করতেই হবে। বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে সেটা হলো ধ্বংসাত্মক নগরায়ণ। ঢাকার এমন ওয়ার্ড আছে যেখানে ৯০ শতাংশই কংক্রিট। গরম বেশি অনুভূত হয়, কারণ নগর এলাকায় গাছপালা, জলাধার ধ্বংস করা হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত ওপেন স্পেস রাখতেই হবে। তার মতে, নগরায়ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে সবুজের পরিমাণ বাড়িয়ে নগরের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ভবনগুলোর চারদিকে স্পেস বা খালি জায়গা রাখতে হবে এবং এলাকাভিত্তিক পুকুর বা জলাধার রাখতে পারলে তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি রাজউক একটি নীতি প্রণয়ন করেছে, যেখানে প্লটের আকারভিত্তিক গাছের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এটি কার্যকর হলে কিছুটা কাজে আসবে বলে মনে করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ আদিল খান। তিনি বলেন, যত বেশি সবুজায়ন হবে, ততই তাপমাত্রা সহনীয় হবে। জলাধার থাকতেই হবে। পাশাপাশি দুটি ভবনের মধ্যকার দূরত্ব এবং প্রতিটি ভবনের পরিবেশবান্ধব ডিজাইন করতে হবে। একইসঙ্গে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শীতাতপ যন্ত্র ব্যবহার হতে হবে নিয়ন্ত্রিত। হিট ওয়েভ বা তাপপ্রবাহ হলো অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া। আর এ তাপপ্রবাহ সম্পর্কে যে সতর্কতা জারি করা হয়, সেটাই মূলত হিট অ্যালার্ট বা হিট ওয়েভ অ্যালার্ট। তাপপ্রবাহ চরম মাত্রায় বাড়লে আরো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়। এছাড়া মানুষের সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে হতে পারে মৃত্যুর কারণ। তাই সবাইকে আসন্ন তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে সতর্ক করার জন্যই হিট অ্যালার্ট জারি করে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close