মিজান রহমান
উপজেলা নির্বাচন
দ্বন্দ্ব নিরসনে নৌকা রাখছে না আ. লীগ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর এখন তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিভেদ দ্রুত নিরসন করতে চায় আওয়ামী লীগ। সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বনাম স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হয়েছে, নিরসনের উদ্যোগ হিসেবে সারা দেশে সাংগঠনিক সফরসহ নানা কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। এজন্য বিভাগীয় নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে দলীয় একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে এবার দলীয় প্রার্থীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও মাঠে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। এতে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক জায়গায় বিভক্ত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। শুরু হয় নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যা ভোটের পরও অব্যাহত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো ঘটছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের ঘটনা।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, দলের প্রথম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে মূল আলোচনা ছিল দলের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা। এজন্য সামনের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার সিদ্ধান্তও হয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে সোমবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম সভা শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী, দলীয় প্রার্থী সব মিলিয়ে কিছু মান অভিমান, অন্তর্কলহ ছিল, যার রেশ এখনো শেষ হয়নি কিছু জায়গায়। নির্বাচনের পর সে অবস্থায় সব বিভাগীয় কমিটিকে নেত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, বিভিন্ন জেলার অভ্যন্তরীণ সমস্যা এগুলো সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঢাকায় ডেকে এনে সমাধান খুঁজে বের করা হবে এবং সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের ভেতরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কোন্দল প্রকাশ্যে চলে এসেছে। অনেক জায়গায় নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই মুখ দেখাদেখি বন্ধের উপক্রম। সংসদ নির্বাচনের সময় দলের তৃণমূলে যে কোন্দল ও বিভক্তি তৈরি হয়েছে, সেটি মেটাতে হবে। আশা করি অভ্যন্তরীণ কোন্দলগুলো নিরসনে আবার দলকে ঐক্যবদ্ধ করে বিএনপি-জামায়াতের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র চক্রান্ত মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।’
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল, ভোটের মাঠ উন্মুক্ত করে দেওয়া। দলের এই সিদ্ধান্তের কারণে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল-সর্বস্তরের নেতারা এবার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান। এবারের নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে ৩৫০-এর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যার মধ্যে ২৬৯ জনই ক্ষমতাসীন দলের। প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকেই নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি আরো নাজুক হয় নির্বাচনের পর। নির্বাচনের ফলে দেখা যায়, ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন, যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রেকর্ড।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক শীর্ষ নেতা ও হেভিওয়েট নৌকার প্রার্থীও এবার হেরেছেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন কিন্তু জিততে পারেনি এমন পরিচিত নেতাদের মধ্যে আছেন বিগত সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। এছাড়াও হেরেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান মিয়া, টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল প্রমুখ।
নির্বাচনের পর গত এক সপ্তাহে সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় শতাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। নির্বাচনের পর সহিংসতার খবর বেশি পাওয়া গেছে মুন্সীগঞ্জ, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, রাজশাহী, পিরোজপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, খুলনা, পটুয়াখালীসহ আরো বেশ কয়েকটি জেলায়।
এসব সংঘাত-সহিংসতার বেশিরভাগই ঘটেছে নৌকা প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে, যারা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।
দলীয় সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে আটটি বিভাগীয় কমিটি দিয়েই তৃণমূলে বিরোধ মেটানোর পরিকল্পনা করেছে আওয়ামী লীগ। নিজ নিজ এলাকার কেন্দ্রীয় নেতারাই এসব কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন। কোন এলাকায় কার সঙ্গে কার বিরোধ, সেটি চিহ্নিত করাই হচ্ছে কমিটির প্রথম কাজ। এরপর প্রতিটি সেসব জেলায় গিয়ে চিহ্নিত পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিরোধ মেটাতে কাজ করবে কমিটি।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, এরই মধ্যে সব কমিটির কাছে নির্দেশনা পৌঁছে গেছে এবং তারা কাজও শুরু করে দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, কোন্দলে লিপ্ত পক্ষগুলোর সঙ্গে বসার পরও যদি বিরোধ না মেটে তাহলে তাদের ঢাকায় কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে বসানো হবে। এরপরও যদি কেউ দলের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অমান্য করে, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে বহিষ্কার করা হবে। আমরা আশা করছি সবাই দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। তারপরও যদি কেউ অমান্য করতে চায়, সেক্ষেত্রে আমরা কঠোর থেকে কঠোরতর হব। বিভেদ জিইয়ে রাখা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
"