গাজী শাহনেওয়াজ
নতুন ভূমি আইন
রেকর্ডের ভুলে নামজারি ও রেজিস্ট্রেশনে ভোগান্তি
ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তিতে সরকারি কর্মকর্তাদের অনীহা বাড়ছে। এর মূল কারণ জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা এসিল্যান্ডদের (উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা) হাতে থাকলেও খতিয়ানে ভুলের সংশোধন করতে হয় আদালতের মাধ্যমে। ফলে মামলাসংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভূমিসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের হাজার হাজার মানুষ। জানা গেছে, একটি রেকর্ড সংশোধনের মামলা নিষ্পত্তি করতে ন্যূনতম সময় লাগে ৭ থেকে ৮ বছর। ফলে ভুক্তভোগীদের চরম ভোগন্তির শিকার হতে হয়। উকিল ও মুহুরীকে টাকা দিতে দিতে মামলার বাদী-বিবাদীকে হতে হয় সর্বস্বান্ত।
ভুক্তভোগী ও ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে ভূমির রেকর্ড ও খারিজসংক্রান্ত বিরোধ ফয়সালার ক্ষেত্রে নতুন ভূমি আইনের কারণে এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আটকে আছে অনেক ভূমির রেজিস্ট্রেশন ও অধিগ্রহণের কাজ। এতে জমির প্রকৃত মালিকরা হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত; সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব আয়। অতীতে নজির ছিল, ছোট-খাটো ভুলের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ অথবা পৌরসভার মেয়র প্রত্যয়নপত্র দিলেই জমি রেজিস্ট্রি করতে পারত। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে নতুন ভূমি আইন কার্যকর হওয়ায় জনগণ সেই সহজ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে দেখা গেছে, কোনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আয় হতো। চলতি বছরে অক্টোবর পর্যন্ত ২৭ কোটি টাকাও রাজস্ব আদায় হয়নি। এর প্রধান অন্তরায় বিতর্কিত ভূমি আইন।
জানা গেছে, এ জটিলতার ফাঁদে পড়েছেন ডিসি-এডিসি-এসিল্যান্ডরা। তারা বলছেন, ‘জনগণের স্বার্থ দেখবেন, না সরকারি স্বার্থ রক্ষা করবেন।’ ফলে এ ধারাটি জমির বিরোধ নিষ্পত্তিতে গোদের ওপর বিষফোড়া এখন। ভূমি আইনে এমন বিধান আওয়ামী লীগ সরকার যুক্ত করায় একদিকে বিপাকে পড়েছেন দেশের জনগণ; অন্যদিকে বিরোধে নিষ্পত্তি করতে অনীহা প্রকাশ করছেন ডিসি-এডিসি-এসিল্যান্ডরা। এদিকে ভূমিসেবায় জনগণের দুর্ভোগ ও হয়রানি বন্ধে ভূমি আইন সংস্কার ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালকরণে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। গত ২৪ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিচালক প্রশাসন এ কে এম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে ভূমিসেবায় জনগণের দুর্ভোগ ও হয়রানি বন্ধে সারা দেশে মাঠ প্রশাসনে ডিসি-এডিসি এবং এসিল্যান্ডদের নির্দেশনা দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এদিকে ভূমি মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার না হন। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে- যাতে করে কেউ ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়ে ডিসি-এডিসি-এসিল্যান্ডদের নির্দেশনা দিয়েছেন ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। গত সোমবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটির ১৪৪তম সভায় সভাপতির বক্তব্যে হাসান আরিফ বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় জনস্বার্থে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম নিয়ে প্রায়ই অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়। ভূমি মালিকগণ ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার হন। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে- যাতে করে কেউ ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত বা মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ না পান।
এ সভায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় বলা হয়, বিগত ১৪৩তম সভার কার্যবিবরণী কোনো সংশোধনীর প্রস্তাব ছাড়া পাস করা হয়। সভায় এলজিইডির অধীনে ঢাকা জেলার ২৭ মৌজায় সড়ক নির্মাণে ২.৫৭ একর, মেট্রোরেল স্টেশনে যাত্রীদের জন্য ফুটপাত নির্মাণে তেজগাঁও এলাকায় ০.৩১১৫১ একর, ঢাকা-বাইপাস সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ১.১৪০২ একর ও গাজীপুর সদর উপজেলায় ৫.০৮৩৬ একর, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পে ১.১৩২৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রস্তাবগুলো পাস করা হয়।
তবে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন এসেট প্রকল্পের অধীন গাজীপুর জেলার সদর উপজেলায় কাউলতিয়া মৌজায় ১৪.৪৯ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রস্তাবটি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভূমি উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের অধীন সেতু নির্মাণের সময় উচ্চতা সঠিকভাবে নির্ধারণ না হওয়ায় বর্ষায় পানির গভীরতা বেড়ে গেলে নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হয়। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। এজন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ, শিল্পায়ন ও বসতবাড়ি নির্মাণে দেশের কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। এজন্য নির্মাণকাজে নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে ভূমির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি প্রকল্প গ্রহণে জলাশয় ভড়াট না করা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার বাসিন্দার আবুল হাসান তার বাবার বাড়ি ভিটার জমিভুলবসত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নামে মহানগর জরিপে করণিক ভুলে নতুন রের্কড হয়েছে। গত ১৫ বছর ধরে জমির রের্কড সংশোধনের আবেদন করেও তা পাচ্ছে না। তার জমিতে চার ভাই বাড়ি করে বসবাস করে আসছেন। কিন্তু জমির রেকর্ড সংশোধন করতে পারছে না। এরকম সারা দেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষ এ সমস্যা শিকার হচ্ছেন। দেশের গোটা ভূমি খাতকে ডিজিটাইজেশনের আওতায় এনে ভোগান্তি দূর করার চেষ্টা করা হলেও মানুষের হয়রানি, ভোগান্তি দূর হয়নি। বিশেষ করে জরিপে অব্যবস্থাপনার কারণে ভূমি নিয়ে মানুষের বিরোধ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত চলছেই। জমি অন্যজনের নামে রেকর্ড করা হয়েছে। মামলা-মোকদ্দমা করেও মালিকানার সংকট দূর হচ্ছে না। কারসাজি করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। উন্নত জমিকে নিম্নশ্রেণি উল্লেখ করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।
ভূমি মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশন বাস্তবায়নের কাজ শুরু করলেও ভূমির মালিকানাসহ নানা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য রয়ে গেছে। জমির মালিকনা নিয়ে খতিয়ানের করণিক ভুল, প্রতারণামূলক লিখন এবং যথার্থ ভুল সংশোধনের ক্ষমতা জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সহকারী কমিশনার হাতে থাকলেও তা বাস্তাবায়ন করছে না এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বাক্ষরিত পরিপত্র মানছে না ডিসি-এডিসি-এসিল্যান্ডরা। আবার ১৯৬২ সালের রেকর্ড সংশোধন মামলায় আদালতের রায়ে জমির মালিকরা মিস কোস করেও এডিসি ও সরকারি কমিশনারদের কাছে সুবিচার পাচ্ছে না বলে শত শত অভিযোগ ভূমি মন্ত্রণালয়ে। আবার অনেক জেলায় ভূমি কর্মকর্তারা জনগণের পক্ষে সংশোধনের প্রস্তাব দিলে সেসব কর্মকর্তাদের বদলি করা হচ্ছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সালেহ আহমেদ বলেন, আমি এখনো নতুন, তবে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখব। যশোরের জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে মো. আজাহারুল ইললাম বলেন, আমি আমার জেলায় দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিদেশনা দিয়েছি। ভূমির বিষয় সঠিকভাবে নিশ্চিত হয়ে ভুল সংশোধন করতে হবে। সেভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সহকারী ভূমি কর্মকর্তারা কাজ করছেন। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও দেশের অনেক জেলা-উপজেলায় জমির প্রকৃত মালিকের নামে রের্কড শেষ হয়নি। আবার যেসব এলাকায় চূড়ান্তভাবে রের্কড প্রকাশ করা হয়েছে। আবার যেসব জেলায় ভূমি জরিপের চূড়ান্তভাবে মুদ্রিত ও প্রকাশিত করা হয়েছে, সেখানে করণিক ভুলের কারণে হয়রানি বাড়ছে। বাংলাদেশের দেওয়ানি মামলার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই ভূমিসংক্রান্ত। ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে প্রায় ৩ লাখেরও বেশি মামলা ঝুলছে। ফলে ভুক্তভোগীদের ভূমিসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাই ভূমি অপরাধ দমনে প্রস্তাবিত ল্যান্ড ক্রাইম অ্যাক্ট বাস্তবায়ন যত দ্রুত করা সম্ভব হবে, তত দ্রুত জনদুর্ভোগ কমে আসবে। দেশের ভূমি অফিসগুলো এখনো পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত নয়। সরকারের আপ্রাণ চেষ্টার পরও প্রভাবশালী মহলের কারণে ভূমি সেবা প্রদানে এখনো সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
ভুল বা যথার্থ ভুল সংশোধনের বিষয়ে দেওয়ানি আদালতের রায় মোতাবেক সরকারি জমির ক্ষেত্রে নামজারি কার্যক্রম গ্রহণ সংক্রান্ত ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের জারিকৃত পরিপত্রে এর সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। খতিয়ানের নির্ভুল কপি জরিপের ওয়ার্কিং ভলিউমে আছে, কিন্তু খতিয়ান বহিতে বাঁধাইয়ে ভিন্নরূপ খতিয়ান বাঁধাই হওয়া বা অনুরূপ কোনো প্রকৃত ভুল বা যথার্থ ভুল বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) অবহিত হলে বা তার নিকট আবেদন করা হলে তিনি অবিলম্বে একটি মিস কেস চালু করে শুনানি ও অনুসন্ধানের পর তথ্য-উপাত্ত এবং মতামতসহ নথি সিদ্ধান্তের জন্য কালেক্টরের নিকট প্রেরণ করবেন এবং কালেক্টরের আদেশানুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে কালেক্টর প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের মতামত গ্রহণ করতে পারেন।
ভুক্তভোগী এ বি রাজ্জাক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, নতুন ভূমি আইনের কারণে পিতা-মাতা তার সন্তানকে সম্পত্তির দানপত্র দিলে সেই ক্ষেত্রে খাজনা গ্রহণ ও খারিজ বাধ্যতামূলক। কিন্তু সম্পত্তি যেহেতু ত্রিপক্ষের হাতে যাচ্ছে না বা হস্তান্তরিত হচ্ছে সেই ক্ষেত্রে খারিজ বাধ্যতামূলক অবশ্যই জমির মালিককে হয়রানির শামিল। পাশাপাশি জমি রেজিস্ট্রেশন করাও ব্যাহত হচ্ছে। ওদিকে একজন রিকশাওয়ালাও জমি এক টুকরো জমি ক্রয় করে সেই ক্ষেত্রে আয়করের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করায় ভূমি রেজিস্ট্রে এখন তলানিতে এসেছে পৌঁছেছে। এ শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্যে উচ্চবিত্তরা আরো সম্পদশালী হচ্ছে। নিম্নবিত্তরা হতাশ হচ্ছে। এ বিতর্কিত অসম ভূমি আইন বাতিল করা না হলে জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না এবং সরকার রাজস্ব হারাতে থাকবে।