মিজান রহমান

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪

জাতীয় পার্টিতে ফের ভাঙনের সুর

জাতীয় পার্টি (জাপা) আবারও ভাঙনের দিকে যাচ্ছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, প্রার্থীদের খোঁজখবর না নেওয়া, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত না করা এবং বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ায় শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। তারা দলের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি ক্ষুব্ধ।

জাপার একটি সূত্র প্রতিদিনের সংবাদকে বলেছে, নির্বাচনে ভরাডুবি হওয়ার কারণে চরম অস্থিরতা চলছে জাতীয় পার্টিতে। দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদপন্থিদের মধ্যে বিভক্তি এখন স্পষ্ট। জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এবং দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পৃথক জাপা গঠনেরও সিদ্ধান্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে গত বুধবার জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা। শীর্ষ এই নেতাদের পদত্যাগের আলটিমেটামও দেওয়া হয়। তারা বলেছেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ না করলে এ ২ নেতাকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

বর্তমান চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ জাপার শীর্ষ নেতাদের ওপর বিক্ষুব্ধ অংশটি গতকাল কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বর্ধিত সভা করেছে। বিক্ষুব্ধরা তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের শরণাপন্ন হয়েছেন। জাপার কো-চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকায় দলটির শীর্ষ নেতারা এখন চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন। পঞ্চম দফায় দলের ভাঙন রোধ করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

গত রবিবার রাজধানীর কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিশেষ সভায় জাপার পরাজিত প্রার্থীসহ বিক্ষুব্ধ নেতারা দলের এই নাজুক পরিস্থিতির জন্য এই দুই নেতাই দায়ী। সভায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৩০ জন বক্তব্য দেন। উপস্থিত ছিলেন ১২২ জন।

তৃণমূল প্রার্থীদের মধ্যে বক্তব্য দেন মুন্সীগঞ্জ-৩ এর আবদুল বাতেন, সিরাজগঞ্জ-৫ এর ফজলুল হক নুরু, নোয়াখালী-৩ এর ফজলে এলাহী সোহাগ, সিলেট-২ এর ইয়াহিয়া চৌধুরী, সিরাজগঞ্জ-৬ এর মোক্তার হোসেন, সিরাজগঞ্জ-১ এর জহিরুল ইসলাম, গাজীপুর-৪ এর শামসুদ্দিন খান, ভৈরবের নুরুল কাদের সোহেল প্রমুখ। বক্তব্যে নেতারা বলেন, জি এম কাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন অথচ উনার দলেই কোনো গণতন্ত্র নেই। উনি দলটিকে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন।

সভায় সিরাজগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী জহিরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে গিয়ে আমার ওপর হামলা হলো, কর্মীদের ওপর আক্রমণ হলো। চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে অভিযোগ জানাতে ফোন দিলে তারা কল ধরেননি। আর্থিক সহযোগিতা না করলেও আমাদের তো অনন্ত সাহস দিতে পারতেন। আমি এসেছি, দুঃখ কষ্টের কথা বলতে। আমাকে বহিষ্কার করবেন করেন। আগে বাবলা, খোকাদের করেন।

সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের প্রার্থী মোক্তার হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে দল থেকে বলা হলো নির্বাচন করো। তুমি কিছু খরচ করো, আর বাকিটা দল দেবে। সে মোতাবেক আমি দোকান বিক্রি করে প্রথম কয়েক দিন প্রচারণা চালিয়েছি। পরে জি এম কাদের ও চুন্নুকে কল দিলে তারা আর রিসিভ করেননি। এরাই জাপাকে ডুবিয়েছে।

নোয়াখালী-৩ আসনের প্রার্থী ফজলে এলাহি সোহাগ বলেন, আমাদের নেতারা লোভী অথবা আপনি লোভী। চুন্নু সাহেব কৌশলের কথা বলেছেন। কিসের কৌশল? পুরো দলকে ধ্বংস করার কৌশল?

চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কা?দেরকে উদ্দেশ্য করে সিলেটের প্রার্থী ইয়াহিয়া চৌধুরী বলেন, আপনি গণতন্ত্র শিখিয়েছেন, আপনার ম?ধ্যে গণতন্ত্র নেই। আপনি স্ত্রীর জন্য ফিরোজ, বাবলা, খোকা, পীর ফজলু, আতিক, ভাসানীসহ ৯টি সিট কোরবানি দিয়েছেন।

ভৈরবের নুরুল কাদের সোহেল বলেন, আমরা সব কিছু দিয়ে নির্বাচন করেছি। নেতারা খবর নেননি, দশটা টাকাও দেয়নি। আর কত মাথা বিক্রি করবেন। আপনাদের কথায় আর ভুলব না।

সভায় জাপার কেন্দ্রীয় সদস্য সাহিন আরা চৌধুরী রিমা বলেন, শেরিফা কাদেরের কী অবদান আছে জাতীয় পার্টিতে! তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করতে হবে, এমপি বানাতে হবে কোন যুক্তিতে?

সভায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, শুধু নিজের স্ত্রীর জন্য পার্টির হেভিওয়েট নেতাদের রাজনীতির মাঠে জবাই করেছেন জি এম কাদের। আজকে যদি সব বহিষ্কৃতরা এক হয় তাহলে আপনার (জি এম কাদের) টিকে থাকা কঠিন হবে।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বলেন, জি এম কাদের যদি নির্বাচনে না যেতেন তাহলে জাতির কাছে তিনি হিরো হতেন। আগামীর বাংলাদেশ হতো জাপার। আমাদের।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপার বর্তমান ২ নেতার অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের একটি অংশ দলীয় কার্যালয়ের সামনে গত ১০ জানুয়ারি বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু পদত্যাগ দাবি করেন। জাপার শীর্ষ এই ২ নেতা এসব আমলে নেননি। বরং শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে হুমকি দেন মুজিবুল হক চুন্নু। ১১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বনানী কার্যালয়ের সামনে আবারও বিক্ষোভ করেন দলটির নেতাকর্মীরা। চেয়ারম্যান জি এম কাদের সমর্থকরা মনে করেন, বিক্ষোভের এই ঘটনার নেপথ্যে কাজী ফিরোজ রশীদ ও সুনীল শুভ রায়ের ভূমিকা রয়েছে। তবে জাপা যে এবার ফের ভাঙনের শিকার হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই বলে জানিয়ে দলীয় সূত্র।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close