ড. জাহাঙ্গীর আলম

  ১৫ আগস্ট, ২০২৩

বঙ্গবন্ধুর কৃষিদর্শন ও অর্ধশতাব্দীর কৃষি উন্নয়ন

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এ দেশের কৃষকরা ছিলেন শোষিত। উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদনব্যবস্থা ছিল কৃষকদের প্রতিকূলে। ফলে উৎপাদনে তাদের উৎসাহ ছিল কম। প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নমানের। ফলে এ দেশ ছিল ঐতিহাসিকভাবে একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে এ দেশে ব্যাপকভাবে বিঘিœত হয় কৃষি উৎপাদন। প্রয়োজনীয় বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণের অভাবে ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে কৃষিপণ্যের বিপণন দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল দেশে মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ।

বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে। তখন থেকেই কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়; সহজ ও সুলভ করা হয় কৃষি উপকরণ সরবরাহ; পানি সেচ সম্প্রসারিত করা হয়; অনেকটাই নিশ্চিত করা হয় কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায়সংগত মূল্য। তাতে উৎপাদনে আগ্রহী হন কৃষকরা। এতে বেড়ে যায় কৃষির সার্বিক উৎপাদন। বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্যের উৎপাদনে প্রায় স্বয়ম্ভর। পরনির্ভরতা অনেকটাই কম। ধানের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে আমাদের স্থান সবার ওপরে। তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, পাট রপ্তানিতে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়। ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টমণ্ডবিভিন্ন তথ্য থেকে এসব জানা যায়।

১৯৭২ সালে এ দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল এক কোটি টন। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে চার কোটি টনেরও ওপরে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। এ সময় সারা বিশ্বের গড় উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। অর্থাৎ বাংলাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল সারা বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে বেশি। চিরকালের খাদ্য ঘাটতি, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার তথা আওয়ামী লীগের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলেই সম্ভব হয়েছে এই বিপুল উন্নয়ন। এর ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের। যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশের কৃষিক্ষেত্রে তিনি যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তার অন্যতম ছিল ভূমি সংস্কার। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ৯৬ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির সব খাজনা রহিত করেন। রাষ্ট্রপতির ৯৮ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়; উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হয় ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু আশ্রয়হীনদের জন্য গড়ে তোলেন গুচ্ছগ্রাম। নতুন জেগে ওঠা চর ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করেন বিনামূল্যে। গরিব কৃষক ও খেতমজুরদের বাঁচানোর জন্য তাদের রেশনের আওতায় নিয়ে আসেন।

বাংলাদেশের কৃষকদের ঋণগ্রস্ততার কথা বঙ্গবন্ধু ভালোভাবে জানতেন। তাই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পাকিস্তান আমলে নেওয়া কৃষকদের সব ঋণ সুদসহ মাফ করে দেন। তাদের বিরুদ্ধে করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট কেইস তিনি প্রত্যাহার করে নেন। উচ্চ সুদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য এবং তাদের কাছে অবাধে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। গ্রামবাংলার কৃষকদের উৎপাদনে উৎসাহিত করা এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বঙ্গবন্ধুর সরাসরি তত্ত্বাবধানে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে কৃষিবিপ্লবের বিকাশের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তার এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘দেশের কৃষিবিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না।’ এ কৃষিবিপ্লবে দেশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি কৃষি উপকরণের ওপর উদার সহায়তা দেন। একটি গভীর নলকূপের দাম ছিল প্রায় দেড় লাখ টাকা। সেটি কৃষক সমবায়কে মাত্র ১০ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্টে প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন বঙ্গবন্ধু। এ ছাড়া প্রতি ইউনিট পাওয়ার পাম্পের দাম ছিল প্রায় ২২ হাজার টাকা। সেটি ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬০০ টাকায়। সরকারের উদ্যোগে আধুনিক বীজ সরবরাহ করা হয়েছে নামমাত্র মূল্যে; কীটনাশক বিতরণ করা হয়েছে প্রায় বিনামূল্যে। তা ছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভর্তুকি মূল্যে ট্রাক্টর ও টিলার সরবরাহ করা হয়েছে। তাতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমেছে। অন্যদিকে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছেন বঙ্গবন্ধু। ধান, পাট, তামাক, আখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যূনতম বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এভাবে তিনি কৃষির উৎপাদনকে লাভজনক করে তোলেন দেশের কৃষকদের জন্য।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে উন্নয়ন বরাদ্দের ৩১ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। দেশের আর্থিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল কৃষি উন্নয়নের ওপর। এজন্য তিনি সর্বাগ্রে কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচি জোরদার করেন। গড়ে তোলেন অনেক নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। তা ছাড়া কৃষির সব উপখাতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষকপর্যায়ে তার পরিধারণ এবং গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের জন্য তিনি বিশেষ তাগিদও দেন। সেই সঙ্গে তিনি বন্যানিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।

বঙ্গবন্ধু দেশের অন্যান্য কারিগরি গ্র্যাজুয়েটদের (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার) অনুরূপ কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা নিশ্চিত করেন। তাদের টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হিসাবে ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে তাতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কৃষিশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষাজীবন শেষে মাঠে নেমে কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করেন সেই পরামর্শও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু আমাদের কৃষিব্যবস্থায় কৃষকের দারিদ্র্য এবং জমির খণ্ডবিখণ্ডতাকে উৎপাদন বৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই তিনি কৃষি সমবায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার ভাবনা ছিল প্রতিটি গ্রামে বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলা। তাতে আধুনিক চাষাবাদ হবে। সম্ভব হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে মিলিতভাবে কৃষিপণ্যের বাজারজাতও সম্ভব হবে। তাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যাবে। এর মাধ্যমে গ্রামের ভূমিহীন কৃষক ও যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের কৃষকরা সব ধরনের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবেন। তাই সমবায়কে উৎসাহিত করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু দেশের খাদ্য সংকট নিরসনের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে চেয়েছেন। আধুনিক কৃষি উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতি একর জমির উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিন গুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিন গুণ করতে পারব না? ...যদি ডাবল ফসলও করতে পারি আমাদের অভাব ইনশা আল্লাহ হবে না’।

বঙ্গবন্ধু আজ নেই। তিনি লোকান্তরে। কিন্তু এ দেশের ঘরে ঘরে অতীতের মতো অভাব-অনটন আর দৃষ্টিগোচর হয় না। দেশের কৃষি উৎপাদন ডাবল, ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি হয়েছে। আমাদের এখন খাদ্য সংকট নেই বললেই চলে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে কৃষি উন্নয়নের এক অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হয়েছে। কৃষকদের জন্য তিনি উদার সহায়তা দিচ্ছেন। সব দুর্যোগে ও দুঃসময়ে তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন; সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। এ দেশের কৃষক এখন আর শোষিত ও বঞ্চিত নন। তারা সম্মানিত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার এক কালজয়ী ভাষণে দেশের কৃষকদের ইজ্জত দিয়ে কথা বলতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক। ...ওদের সম্মান দিয়ে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন, ওরাই মালিক’। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতার ওই আদর্শ অন্তরে ধারণ করেছেন এবং যুগ যুগ ধরে তা পালন করেছেন। তিনিও পিতার ওই নির্দেশনার অনুকরণে প্রাণের সব মমতা ঢেলে দিয়ে বলেছেন, গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিচ্ছেন আমাদের কৃষকরা। তারা মানুষের ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করছেন। তাই দেশের কৃষকদের আমাদের মাথায় তুলে রাখা উচিত। এদের সবচেয়ে সম্মান দেওয়া উচিত। এ বিষয়টি আমাদের জাতীয় কৃষিনীতিতে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকা দরকার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close