কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি

  ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

কুষ্টিয়ার কুমারখালী

‘পাখাগ্রাম’ মটমালিয়াট

ঢাকাসহ দেশের ৪৫টির বেশি জেলার ওপর দিয়ে এখন তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে, দিনের গড় তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। ফলে তীব্র গরম অনুভূত হওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় হাতপাখার কদর বেড়েছে। হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ৪ নম্বর সদকী ইউনিয়নের মটমালিয়াট গ্রামটি এখন পাখাগ্রাম হিসেবে পরিচিত। এই গ্রামের প্রায় দেড়শতাধিক পরিবার হাতপাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত।

গত রবিবার সরেজমিনে মটমালিয়াট ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব বাড়ির ঘরের আঙিনায় বসে হাতপাখা তৈরির ব্যস্ততা চলছে। তৈরি করছেন তালপাখার হাতপাখা। এ সময় দেখা যায়, কেউ তালপাতা চিরিয়ে নিচ্ছেন, কেউ হাতপাখা তৈরি করছেন, কেউ তৈরি করা হাতপাখায় বেত দিয়ে চাকা বাঁধছেন, আবার কেউ তালপাতায় রং মাখাচ্ছেন। একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। কিছু কিছু পরিবারের পুরুষ বাঁশ কেটে তাদের কাজে সহযোগিতা করছেন।

হালিমা বেগম এক কারিগর বলেন, কয়েকজনের শ্রমে তৈরি হয় একটি হাতপাখা। পাখা তৈরির মূল উপকরণ তালপাতা, বেত, বাঁশ, প্লাস্টিক ও রং। প্রথমে তিন-চার ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে অথবা রোদে রাখা হয় তালপাতা। এরপর সেই পাতা সুবিধামতো আকারে কাটা হয়। এরপর সরু লম্বা কাঠি দিয়ে বেঁধে ও রং করে পাখা তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, একজন নারী প্রতিদিন ৬৫ থেকে ৭৫ পিস পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারেন। ৭৫টি হাতপাখা সুতা দিয়ে সেলাই ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের বিনিময়ে পেয়ে থাকেন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। কারিগর রহিম মালিথা, সাত্তার শেখ, জুরান শেখ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জেলা ও জেলার বাইরে থেকে পাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল তালের পাতা পিস প্রতি কেনা হয় ১০-১৫ টাকা দরে। প্রতি পিস পাতায় ৮- ১০টি তালপাখা তৈরি করা যায়। প্রতিটি বাঁশ কেনা হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। এক একটি বাঁশে পাখা হয় শতাধিক।

প্রতিটি পাখা তৈরিতে খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ টাকা। পাখাগুলো মানভেদে পাইকারি বিক্রয় হয় ১৮ থেকে ২৫ টাকায়। আর হাত বদলে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত গিয়ে সেটির মূল্য দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এখানকার তৈরি করা পাখা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরেও যায়। তবে তাপমাত্রার সঙ্গে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে পাখার চাহিদার। হাতপাখার কারিগর উজ্জ্বল হোসেন বলেন, মৌসুমের শুরুতে ১৩০ থেকে ১৪০টি পাখা তৈরি হলেও গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০০ থেকে ২৫০টি পাখা তৈরি করতে হচ্ছে। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হাতপাখার প্রধান উপকরণ তালপাতা সংকটের কথাও জানান তিনি।

কারিগর আজমত আলী বলেন, চাহিদা বেশি থাকলেও হাতপাখা তৈরির উপকরণ যেমন তালগাছের পাতা, বাঁশ, সুতা, ভিন্ন ভিন্ন রং, মোম ইত্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সেই তুলনায় লাভ কম হওয়ায় পরিবার নিয়ে আর্থিক কষ্টে ভুগতে হয়। আর্থিক সংকট নিরসনে সরকারি সহায়তার কথাও বলেন কুটিরশিল্পের এই কারিগর।

পাখাগ্রাম থেকে সংগৃহীত পাখা আশপাশের জেলা-উপজেলায় বিক্রয়কারী একাধিক পাইকার জানান, এখানকার তৈরি পাখার গুণগত মান ভালো থাকায় বাজারে এর কদর রয়েছে। বাজারে চাহিদা থাকায় বিক্রি ও মুনাফা দুটোই ভালো হয় বলেও জানান তারা।

এ বিষয়ে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ফেরদৌস নাজনীন বলেন, তালপাখা কুমারখালীর একটি ঐতিহ্য। এই পেশায় পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে জড়িত নারীরাও। এ পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে জামানত ছাড়া সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।

কুমারখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিরুল আরাফাত বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে উদ্ভূত বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় তালপাখা প্রযুক্তির বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। এতে খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে অনেকের। উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে একটি অ্যাপস তৈরি করে সেখানে উদ্যোক্তা হিসেবে তালপাখা তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে এরই মধ্যে যুক্ত করা হয়েছে। এই কুটিরশিল্পকে ত্বরান্বিত করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close