অরূপ তালুকদার

  ০৬ মার্চ, ২০২০

যাত্রাগান

যাত্রাপথের নতুন যাত্রা

ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য বা যাত্রাগান আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। লোকজ ঐতিহ্যের সঙ্গেও রয়েছে গভীর মিল।

সেই প্রাচীনকাল থেকে বাংলার মানুষের অভাবিত আকর্ষণ রয়েছে যাত্রাপালার প্রতি। তাই হয়তো অন্যান্য আরো অনেকের মতোই আমারও ছিল যাত্রা দেখার দুর্দমনীয় টান।

তরুণ বয়সে আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছে বা দূরে যেখানেই বসেছে যাত্রার আসর সেখানেই চলে গেছি, অনেক রাত বিনিদ্র কেটেছে যাত্রার প্যান্ডেলে। শহরের আশপাশেও অনেকবার যাত্রা দেখেছি। দেশের বাইরে কলকাতায় দেখেছি আট-দশবার।

যাত্রার নটনটীদের মধ্যে অমলেন্দু বিশ্বাস, জ্যোৎ¯œা বিশ্বাস, স্বপন কুমারসহ অনেকের অভিনয় দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। থিয়েটার দেখার পাশাপাশি যাত্রাও দেখতাম সুযোগ পেলেই। যাত্রাশিল্পীদের অভিনয়, চোখ ধাঁধানো পোশাক পরিচ্ছদ আর সংলাপ প্রক্ষেপণের ভঙ্গি আমার কাছে এখনো দারুণ লাগে। তবে গ্রামেগঞ্জে এখন আর তেমনভাবে যাত্রার আসর বসে না। রামায়ণগান, কীর্তন, পালাগান বা মনসামঙ্গলের কাহিনি নিয়ে রয়্যানীর আসরও বসে না আগের মতো।

প্রধানত লোককাহিনিভিত্তিক যাত্রাপালা ছিল গ্রামীণ জনপদে বড় আকর্ষণের বিষয়। এর পাশাপাশি ছিল সার্কাস। কোনো গ্রামে সার্কাসের প্যান্ডেল পড়লে তার আশপাশের সব গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে আসত। সার্কাস দেখতে বরিশাল অঞ্চলের লক্ষণ দাসের সার্কাস কোম্পানিতে বাড়তি আকর্ষণ ছিল হাতির খেলা। এসব বলতে গেলে এখন এর আর কিছুই নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে। সেসব দিনের স্মৃতি সেদিন হঠাৎ করে আবার যেন আমার কাছে ফিরে এলো তপন বাগচীর ‘বাংলাদেশের যাত্রাগান : গণমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক বইটি পড়তে গিয়ে।

বইটি লেখকের, তার ভাষায়, বর্তমান গ্রন্থটি আমার ‘বাংলাদেশের যাত্রা : গণমাধ্যম হিসেবে এর সামাজিক প্রভাব (১৮৬০-২০০০)’ শিরোনামে প্রণীত গবেষণাÑ অভিসন্ধর্ভে ঈষৎ পরিমার্জিত রূপ। নির্দ্বিধায় বলি, গ্রন্থটি এ বিষয়ে উৎসাহী পাঠক ও গবেষকদের জন্য একটি অমূল্য আকরগ্রন্থ হিসেবেই বিবেচিত হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

পাশাপাশি ধন্যবাদ জানাতে চাই লেখককেÑ কারণ যেভাবে যত তথ্য-উপাত্ত তিনি দীর্ঘ সময় এবং ধৈর্য ধরে সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন স্থান থেকে, নানাজনের সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে, সবটাই ছিল কঠিন কাজ। মনে হয়, অনায়াসেই যেন তিনি সেই আয়াসসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করেছেন অনন্য সাধারণ যোগ্যতায়।

তার এই অসাধারণ কাজটির সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে আছেন ড. আবুল আহসান চৌধুরী (তত্ত্বাবধায়ক), ড, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ, অধ্যাপক স্বপন বসু, ড. আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীসহ অনেক মানুষ।

যাত্রার উৎপত্তি সম্পর্কে নানা জ্ঞানী-গুণিজন তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন নানাভাবে, যা এই গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ আছে। যেমন প্রথম পর্যায়ে ড. আহমদ শরীফ জয়দেব রচিত ‘গীতগোবিন্দম’কে একটি নৃত্যসম্বলিত গীতিনাট্য আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে, এই ‘গীতগোবিন্দম’কে গবেষক পন্ডিত ড. সুকুমার সেন বলেছেন ‘পালাগান’, যা যাত্রাগানের আদিরূপ। যাত্রা গবেষক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচর্যের ধারণা, প্রাচীনকাল থেকেই যাত্রার উদ্ভব হয়েছে।

ড, সুশীল কুমার দে উনবিংশ শতাব্দীতেই যাত্রার সন্ধান পেয়েছেন; বৈষ্ণব যুগে যার উৎপত্তি তার বর্ণনায় : the earliest reference to the ÔyatraÕ probably dates from baishnabas era, indeed we fined the baishnab utilising the popular ÔyatraÕ as a mass of representing krishna- lila and diffusing its novel ideas.

এদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, নাট্য গবেষক সুরেশ চন্দ্র মৈত্র বাঙালির অভিনয় ঐতিহ্যের পাঁচালী, যাত্রা, ঢপকীর্তন, কবিগান, তর্জা, ঝুমুর প্রভৃতির আঙ্গিক পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, যাত্রা ষোড়শ শতকেই জন্ম নিয়েছে।

এভাবে বহু জ্ঞানী-গুণিজন যাত্রার উদ্ভব এবং উৎপত্তিকাল সম্পর্কে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তবে তাদের ধারণা, মন্তব্য ও বক্তব্য ইত্যাদির মতভেদ থাকলেও সেসব থেকে আমরা পরিশেষে এমন ধারণাই পাই যে, যাত্রা প্রাচীনকাল থেকেই আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েই ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। যার সঙ্গে রয়েছে বাঙালির মন ও মানসের অকৃত্রিম আত্মিক বন্ধন।

স্মরণ করা যায়, অসহযোগ আন্দোলনের সময়েও যাত্রাপালাকে কাজে লাগিয়েছিলেন বরিশালের মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের ঘনিষ্ঠ সহচর চারণ কবি মুকুন্দ দাস। যাত্রাপালার মাধ্যমে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের বাণী পৌঁছাতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে।

ধারণা করা যায়, সেই প্রাচীনকাল থেকেই যাত্রাপালা নানাভাবে বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের মানুষদের আনন্দ দিয়ে এসেছে, কখনো কখনো সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও জনমত তৈরিতে সাহায্য করেছে।

গ্রন্থকার তপন বাগচী বলেছেন, ‘যাত্রার বিশেষায়িত ভঙ্গি যেহেতু সাধারণ মানুষের কাছে গ্রাহ্য, তাই এর মাধ্যমে শিক্ষা ও বার্তা প্রচারের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হওয়া আদৌ অসম্ভব নয়।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close