এস এম মুকুল

  ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

ফাগুনে আগুনে বসন্ত

পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার ফুলে ফুলে আগুনঝরা ফাগুনের উচ্ছলতার হাসি। ফাগুন প্রেমের মাস কি-না কে জানে। ফাগুন এলেই কেন প্রেম জাগে মনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ; আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ।’ তবে কি ফাগুন অফুরান প্রেমসূত্রের ঋতু! কোকিলের কুহু-কুহু তান মন আকুল করা বাসন্তী ব্যাকুল হাওয়ায়—মন কেন করে আনচান! প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী; চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপুঞ্জ উঠিছে গুঞ্জরি।

পহেলা ফাল্গুন ঋতুুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। এই দিনটিতে আমাদের চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশে রঙিন আভায় তারুণ্যের চঞ্চলতা হাতছানি দিয়ে ডাকে—বসন্ত বাতাসে। ভাটিবাংলার লোককবি শাহ আবদুল করিম গেয়েছেন—‘বসন্ত-বাতাসে সই গো/বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...এ পত্রিকার পাতায় রঙিন ফুলে ফুলে সজ্জিত প্রকৃতির রূপ তুলে ধরা হয়। টিভি চ্যানেলে চলে বসন্তবরণের অনুষ্ঠান। বাসন্তী রঙের আশাকে-পোশাকে সুন্দরী ললনারা হেসেখেলে বেড়ায় বসন্তের আহ্বানে। পত্রিকায় শিরোনাম হয়—ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত। পহেলা ফাল্গুন। ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে রাজধানী ঢাকায় পালন করা হয় বসন্তবরণ উৎসব। শাহবাগে চারুকলা ভবনের প্রাঙ্গণে বসন্ত বরণের জন্য দিনভর উৎসব চলে। চারুকলার বকুলতলায় সকালে বসন্ত-বন্দনার মাধ্যমে শুরু হয় উৎসব। নাচ, গান ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গান ও কবিতা এ অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ। তবে কি বসন্ত গান আর কবিতার ঋতু। আছে কোনো হেতু নিশ্চয়—নাইবা যদি হবে, এমন দিনে ব্যাকুল কেন হয় এ হৃদয়।

ফাল্গুন যেন একটু এমনই উদাসী হয়ে আসে তরুণ হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ তোলে। ফাল্গুন এলেই শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলেফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। গাছে গাছে স্নিগ্ধ রঙিন কচিপাতারা বাতাসের তালে তালে হেলেদোলে নাচে। ফুল ফোটার পুলকিত এই দিনে তরুণ-তরুণীদের মনে প্রেমের আগুন ঝরে। পহেলা ফাল্গুনে বা ছায়ানট, উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। তবে এখন শুধু ঢাকা নয় সারা দেশে বসন্ত উৎসবে মাতোয়ারা হয় তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে। বাংলা একাডেমির বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চারুকলাসহ পুরো শাহবাগ এলাকায়ই তারুণ্যের জোয়ার যেন উপচে পড়ে। তরুণীদের উচ্ছলতা এই আনন্দ-উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। তরুণরা এই উচ্ছলতায় যেন ফাগুনে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়। কিন্তু যারা বয়সে তারুণ্য ছাড়িয়ে তারাও ভিড় করেন ফাগুনের এই প্রেমাগুন মেলনায়। বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রাঙ্গণ ফুল ও হলুদ রঙের পোশাকের আভায় বাসন্তী রং ধারণ করে। বসন্ত ঋতুজুড়েই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে বসন্তকালীন কবিতা পাঠ, গান ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।


বসন্ত হচ্ছে অনুভব আর আবেগের ঋতু। আগুন রাঙা এই ফাগুন শুধু প্রকৃতিকেই উচ্ছ্বাস আর আবেগের রঙে রাঙায় না, এ আবেগ ছড়িয়ে পড়ে তরুণ প্রাণে। প্রাণের টানে হোক বা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই হোক—এই ঋতু মনকে করে উতলা আর বাঁধনহারা


বঙ্গাব্দ অনুসারে বছরের শেষ দুটি মাস ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল। বসন্ত ঋতুকে ষড়ঋতুর রাজা বা ঋতুরাজ বলা হয়। কারণ বসন্তে প্রকৃতি সাজে রাজকীয় সাজে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়। কুহু-কুহু গান গেয়ে কোকিল প্রেমিক-প্রেমিকার মনহরণের উপলক্ষ হয়। লাল ফুল, নীল ফুল, হলুদ ফুল, গোলাপি ফুল, বেগুনি ফুল, আকাশি ফুল, কমলা ফুল, ঘিয়ে ফুল, সাদা ফুল হাজার রঙের ফুল ফোটে বসন্তে। প্রকৃতির ছয়টি ঋতুর মাঝে বসন্ত যেন একটু বেশিই রমনীয়। বসন্তের প্রধান অনুষঙ্গ হলো ফুল। দেশের বৃহত্তম ফুলের মার্কেট শাহবাগ ও কাঁটাবনের ফুলের দোকানগুলোয় এ উপলক্ষে বিপুল পরিমাণে ফুল বিক্রি হয়। গাঁদা, রজনীগন্ধা ও গোলাপফুলের ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়। পহেলা ফাল্গুন বা বসন্তের প্রথম দিনে বাঙালি নারীরা বাসন্তী বা হলুদ রঙের শাড়ি পরে। অনেকেই তাজা ফুলের অলংকার ব্যবহার করে অথবা চুলে জড়িয়ে নেয় গাঁদা ফুলের মালা। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো সময়ের সঙ্গে মিল রেখে তারা তৈরি করেছে নানা রঙের বসন্তের পোশাক। তারা ফাল্গুনের পোশাকের ফ্যাশনে উজ্জ্বল রংকে প্রাধান্য দেয়। আয়োজনে রয়েছে বাহারি রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, থ্রিপিস, টি-শার্ট, শার্ট। এসব পোশাকে রয়েছে বসন্তের ছোঁয়া। বসন্ত মানেই নতুন সাজ। রঙে-রূপে সবাইকে শুভেচ্ছা জানায় ঋতুরাজ। ভালোবাসার আহ্বান জানায় কোকিলের কুহুতান।

বসন্তে ফোটে ফুল—অশোক, হিমঝুরি, ইউক্যালিপটাস, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গাব, গামারি, গ্লিরিসিডিয়া, ঘোড়ানিম, জংলীবাদাম, জ্যাকারান্ডা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই, পলাশ, পাখিফুল, পালাম, বুদ্ধনারিকেল, মনিমালা, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, রুদ্রপলাশ, শাল, শিমুল, স্বর্ণশিমুল, ক্যামেলিয়া। কাঁঠালি চাঁপার সুবাসে ভরে যায় বাউল বাতাসে। গাছে গাছে থোকায় থোকায় ফোটে সাদা ফুল দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপা হলদে বা লাল রঙেরও হয়। বসন্তকালে অরণ্যের অগ্নিশিখা হয়ে লালে লালে রঙিন হয়ে ফোটে পলাশ ফুল। যতদূর জানা যায়, বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে। বসন্তকে বরণ করে নিতে তরুণ-তরুণীরা বাংলা একাডেমি বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, চারুকলা চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ধানমন্ডি লেক, বলধা গার্ডেন মাতিয়ে রাখে।

অনেকের মতে, বসন্ত হচ্ছে অনুভব আর আবেগের ঋতু। আগুন রাঙা এই ফাগুন শুধু প্রকৃতিকেই উচ্ছ্বাস আর আবেগের রঙে রাঙায় না, এ আবেগ ছড়িয়ে পড়ে তরুণ প্রাণে। প্রাণের টানে হোক বা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই হোক এই ঋতু মনকে করে উতলা আর বাঁধনহারা। কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়ায় গাছের কুড়ির নাচন, আর ভ্রমরের মাতাল ছুটে চলা সবই ঘটে এ বসন্তে। প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলেমিশে বসন্তের হাওয়া আর পুষ্পের রঙে অপার্থিব মুগ্ধতায় হৃদয় নাচবে আপন সুরে, আপন খেয়ালে রাঙিয়ে দেবে কোটি তরুণ প্রাণ।

লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঋতুুরাজ,বসন্ত,পহেলা ফাল্গুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist