আলমগীর খোরশেদ

  ২৪ মে, ২০২৪

ইতিহাস-ঐতিহ্য

প্রিয়জনের দেওয়া রুমাল

গ্রাম, যেখানে পাখির চেঁচামেচিতে সন্ধ্যা হয় আবার সূর্যের গোধূলি রং হতেই বাসায় ফেরা পাখিদের নীল আকাশ ছেয়ে উড়ে আসা কলরব, কে ভুলতে পারে? গ্রামে থাকা মানুষ জীবিকার তাগিদে শহরে এসে থিতু হলেও স্মৃতির পশরা তাকে টেনে নিয়ে যায় বাঁশঝাড়ের ছায়ায়, প্যাঁচার চোখ ঘোরানো জলপাই কিংবা গাবগাছের পাতার আড়ালে। রাত যত বাড়তে থাকে, একটা অজানা ভয় হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, যেন অশরীরী কিছু এই বুঝি আঁধার ঠেলে সামনে এসে দাঁড়াবে। কৃষাণী কিংবা তার ষোড়শী কন্যা অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে। প্রিয় মানুষটি দূরে কাজে গেছে। আসার ঠিক নেই। তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, নির্ঘুম রাত কাটে গ্রামের বিরহকাতর নারীর। ভালোবাসার মানুষটির জন্য রুমাল বানাত তারা। বাঁশ কেটে তা থেকে চিকন চিলতা বের করা হতো। গোলাকার বৃত্তের মতো দুটো চিলতা, তার চিপায় সাদা কাপড়ের একটা টুকরা ঢুকিয়ে টান টান করে চিলতার মাথায় লাগানো স্ক্রু টাইট দিয়ে ফ্রেম বানানো হয়ে যেত। সাদা কাপড়ের টুকরাটা ১২*১২ ইঞ্চি মাপের হতো। কোনো কোনো সময় তার চেয়ে বড়ও হতো রুমালের সাইজ। তবে বেশির ভাগ রুমালই ছোট আকারের হতো। রুমালের ফোঁড়ে ফোঁড়ে থাকত যে বানাচ্ছে তার ভালোবাসা, আবেগ, অভিমান ও অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস। রুমাল বানাতে একটা ফ্রেম, ফুল আঁকার জন্য পেনসিল বা কলম, এক টুকরো সাদা কাপড় লাগত। সাদা জমিনের ওপর লাল, নীল, সবুজ সুতো দিয়ে বোনা হতো প্রিয় মানুষের নামের প্রথম অক্ষর, ফুল, ময়ুর, টিয়ে পাখি কিংবা ছন্দের মিলে কথামালা। লেখা থাকত, ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে’। আরো লেখা থাকত, দুজনের নামের ইংরেজি বা বাংলার প্রথম অক্ষর অ+ঝ মানে আরিফ+শান্তা। কেউ কেউ আরো লিখে রাখত, ‘তেজপাতা তেজ করিল গোলাপ ফুলের বাসনা, তোমার সাথে থাকব আমি, চিরদিনের কামনা’। মেয়েদের হাতে রুমাল থাকা যেন অতি জরুরি ছিল। ছোট একটা সাদা কাপড়ের টুকরা, তাতে পাউডার ঢেলে তার ভেতর ১০ বা ২০ টাকার নোট কিংবা প্রিয় মানুষের চিঠিটা রুমালের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা সহজ ছিল। রুমাল, চিঠি, টাকা হাতের তালুতে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গ্রামের মানুষ তার জামার পকেটে রুমাল রাখত। কাশি, হাঁচি দিয়ে মুখ মোছা, নাক ফুঁকতে, শরীরের ঘাম মোছতে, নারীরা চোখের জল, চিবুক, নাকে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মোছতে রুমাল ব্যবহার ওই সময়ের নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার ছিল। সদ্য বিয়ে বা প্রেমে পড়া মেয়েটি লুকিয়ে রুমাল বানাত রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে। ভাবি-সম্পর্কীয় আত্মীয়রা এ নিয়ে হাসাহাসি, ঠাট্টা-মশকরা করত। দাদা-দাদি বা বয়স্কদের ট্রাংক খোলে পাওয়া যেত ফুল তোলা রুমাল। ন্যাপথলিনের সুবাস ম্রিয়মাণ হয়ে নাকে লাগত পুরোনো হয়ে যাওয়ার গন্ধ। ছেলেরা বিয়ের সময় নাকে রুমাল চেপে বসে থাকে। এটা বংশপরম্পরায় আভিজাত্য, ভদ্রতা দেখাতে বা ট্র্যাডিশনের ছাপ, লজ্জার কারণও হতে পারে। তবে বরের নাকে রুমাল এখন রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে।

সাহিত্যে স্থান পেয়েছে রুমাল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পে কাবুলিওয়ালা রহমত তার বুকপকেটে রাখা মেয়ের হাতের ছাপ ধরে রেখেছে। স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া আত্মজার প্রতি বাবার টান পাঠককুলের চোখ ছলছল করিয়ে দেয়। কোনো ঐতিহাসিক সিনেমার গল্পে নায়িকার সঙ্গে হঠাৎ দেখা নায়কের। প্রথম দেখাতেই মন দেওয়া-নেওয়া। রাজকুমারীর রুমাল নিয়ে যায় রাজকুমার। অনেক দিন পর যুদ্ধে জয়ী রাজকুমার বিয়ে করতে আসে। তার গলায় পেঁচিয়ে রাখা রাজকুমারীর রুমাল। তা দেখে চিনতে পারে। দীর্ঘ বিরহের গল্প শেষ হয়।

প্রাচীন গ্রিস ও রোমে রুমাল ব্যবহার হতো। শেকস্পিয়ার তার ওথেলো নাটকে রুমাল ছিল উল্লেখযোগ্য প্লট ডিভাইস। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার পকেটে পাওয়া গেছে রুমাল। হয়তো তার প্রিয় মানুষটি যতন করে সব প্রেম, ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে রুমালটা বানিয়েছিল। গোপনে বাঁশঝাড় বা করমচাগাছের আড়ালে রুমাল দেওয়াটাই ছিল তাদের শেষ অভিসার। শেষ আকুতি, শেষ মিনতি। রুমাল শুধু এক টুকরা কাপড় নয়, গ্রামের নর-নারীর ভালোবাসার নীরব ক্যানভাস। সেভাবে আমরা কখনো ভেবে দেখেছি কি?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close