প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৭ মে, ২০২৪

ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে নির্ঘুম রাত আতঙ্ক

ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের উপকূলের মানুষ। অথচ এই বাঁধ সংস্কারে বছর বছর ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা। দুর্যোগ এলেই বাঁধ নিয়ে শুরু হয় তোড়জোড়। বরাদ্দ হয় টাকা, এরপরও ভেঙে যায় সেই বাঁধ। আবারও সংস্কারের নামে চলে শত শত কোটি টাকা ওড়ানোর কাজ। সীমাহীন লুটপাটের ফলে হাজার কোটি টাকা খরচ করেও কোনো সুফল মেলে না। মানুষের ভোগান্তিও শেষ হয় না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এত টাকা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হলে বারবার বাঁধ ভাঙত না।

খুলনা-সাতক্ষীরায় দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত পার বাসিন্দাদের : খুলনাঞ্চলের উপকূলের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও বাগেরহাট উপকূলের মানুষ। রাত জেগে স্বেচ্ছাশ্রমে দুর্বল বেড়িবাঁধ সংস্কার করতেও দেখা গেছে।

দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ বেড়িবাঁধই দুর্বল। যদিও খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, কয়রার ৬৩০ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। আর সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ।

খুলনার ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠার আগেই ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী আঘাত হানে। ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ২০২২ সালের ১২ মে আসনি, এরপর একই বছরের ২৫ অক্টোবর সিত্রাং এবং সর্বশেষ ‘মোখা’ আঘাত হানে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়রা, দাকোপ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। যার ক্ষত এখনো শুকায়নি। সর্বশেষ উপকূলে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাত হানার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে চুইয়ে পানি ঢুকেছে। সুভদ্রাকাটি এলাকার একটি জরাজীর্ণ বাঁধ গভীর রাতে স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকাবাসী মেরামত করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সেখানে জিওব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়। আর এলাকাবাসী জিওব্যাগে মাটি ভরে রাস্তা সংস্কার করেন। যেকোনো সময় দুর্বল বেড়িবাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে প্লাবিত হতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকা।

কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের বাঁধের পাশে বসবাসকারী আখতারুজ্জামান ও বিল্লাল হোসেন জানান, আইলার সময় ঘাঁটাখালী বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তাদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়। এরপর দুই মাস আশ্রয় কেন্দ্রে থাকেন। সেখান থেকে বাঁধের ওপরে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের কথায় বাঁধের ওপরে পুনরায় ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। আইলার ১৫ বছর পরও তারা নিজ ঠিকানায় ফিরতে পারেননি। সেখানে বাঁধের পাশে শতাধিক পরিবার রয়েছে। তারা রেমাল ঝড়ের আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউয়িনের চেয়ারম্যান মো. আছের আলী মোড়ল জানান, তার ইউনিয়নের ঘড়িলাল থেকে চরামুখা খেয়াঘাট, খেয়াঘাট থেকে হলদিবুনিয়া পর্যন্ত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিভাগ-২) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম ব?লেন, আমার এরিয়ার মধ্যে ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যা হলে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

পটুয়াখালীতে ঝুঁকিতে বেড়িবাঁধ, আতঙ্কে বাসিন্দারা : আন্দারমানিক নদীপাড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের কিছু অংশ আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। ঘূর্ণিঝড়ের খবরে আতঙ্কে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাঁধের ঢালে বসতি গড়েছেন মো. হানিফ হাওলাদার (৪৫) নামের এক জেলে। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাস হলেই পানির চাপে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনকি বাঁধ ভেঙে ভেসে যেতেও পারে। ঝড়ের কারণে আতঙ্কও বাড়ছে। কারণ ঘূর্ণিঝড়ে নদীতে পানি বাড়লেই জলোচ্ছ্বাসে তার শেষ আশ্রয়স্থল বসতঘরটি আবার ভেসে যাবে।

পাউবো পটুয়াখালী ও কলাপাড়া কার্যালয় জানায়, জেলায় মোট বেড়িবাঁধ রয়েছে ১ হাজার ৮১৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ রয়েছে ১৪ কিলোমিটার। পাউবোর কলাপাড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, কলাপাড়ার নীলগঞ্জের গৈয়াতলা এলাকায় ৭০০ মিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেখানে জিওব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ধুলাশ্বর এলাকায় ৬০ মিটার, রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজে ১২০ মিটারসহ দুই উপজেলায় ৬ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।

ইন্দুরকানীতে ৩০ কিমি বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ : ইন্দুরকানী (পিরোজপুর) প্রতিনিধি জানান, পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে বেড়িবাঁধ না থাকায় নদী তীরবর্তী ৩০ কিমি এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বাড়লে খুব সহজেই উপজেলার পাড়েরহাট, টগড়া, লাহুরী, গাজীপুর, চারাখালী, ইন্দুরকানী, কালাইয়া, সাঈদখালী, ঢেপসাবুনিয়া, বালিপাড়া, চরবলেশ্বর, চন্ডিপুর, খোলপটুয়াসহ অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। এরই মধ্যে রেমাল ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এ উপজেলায় নদীতীরবর্তী বেড়িবাঁধ না থাকায় এ এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

কালাইয়া গ্রামের আ. ছালাম জানান, বিভিন্ন সময়ে নদীভাঙনে বাপ-দাদার জমি ভিটা গ্রাস করেছে কঁচা নদী। বৃদ্ধা বাবা মা, ছেলে-মেয়ে নিয়ে নদীর পাড়ের কোনো রকম ঝুপড়ি ঘরে বেঁচে আছি। বেড়িবাঁধ না থাকায় আজ আমরা পথের ফকির।

ইন্দুরকানী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ করিম ইমন জানান, উপজেলাটি নদীতীরবর্তী হওয়ায় ইন্দুরকানী সদর ইউনিয়নটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বেড়িবাঁধের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close