মেহেদী হাসান

  ২৫ মে, ২০২৪

অনলাইনে জমজমাট জাল টাকা বিক্রি

অনলাইনে বসেছে জাল টাকা বিক্রির হাট! ক্রেতাও নেহাত কম নয়। কোরবানির ঈদ কেন্দ্র করে প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সক্রিয় জাল টাকা বিক্রির চক্র। ঈদে কোরবানির পশু কিনতে ও নতুন টাকার ব্যবসা ছড়াতেই তাদের এ অভিনব কায়দা। রীতিমতো অনলাইনে পেজ খুলে চালানো হচ্ছে প্রচারণা। ঘরে বসে অর্ডার করলেই মিলছে জাল টাকা। সারা দেশে দেওয়া হচ্ছে জাল টাকার হোম ডেলিভারি সুবিধা। অনলাইনে বিজ্ঞাপন হিসেবে জাল টাকা বিক্রি করে কোটিপতি হওয়ার লোভনীয় অফারের ফাঁদ পাতছে এ অদৃশ্য চক্র।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পেজ খুলে জাল টাকা বিক্রি করছেন হাসানুজ্জামান আসাদ। ‘জাল টাকা বিক্রি বাংলাদেশ ডটকম’ নামের পেজের অ্যাডমিন তিনি। একই পেজের আরেক অ্যাডমিন মো. আবদুল খালেক রহমান পোস্ট করেন, ‘এ গ্রেডের নোট আছে। যারা নোট নিতে ইচ্ছুক ইনবক্সে আসেন। সরাসরি এসে নিতে পারবেন অথবা হোম ডেলিভারিতে নিতে পারবেন।’ ছদ্মনামে জাল টাকা বিক্রির জন্য তাদের সঙ্গে ‘মো. শেখ রাবিব শেখ’ নামে আরেকজন রয়েছেন সহকারী।

শুধু এ একটি পেজেই নয়; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অফারে চলছে জাল টাকা বিক্রি। অনলাইনে ফেসবুক, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্নভাবে বিক্রি করা হচ্ছে জাল নোট। অগ্রিম অর্ডার নিয়ে এজেন্টদের মাধ্যমে সারা দেশে দেওয়া হয় হোম ডেলিভারিও। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘জাল টাকার ডিলার’, ‘জাল টাকা বিক্রি করি’, ‘জাল টাকা বিক্রি করা হয় স্যার’, ‘জাল টাকা বিক্রি বাংলাদেশ ডটকম’, ডিলার জাল টাকার’ এমন নানা নামে ফেসবুকে দেখা যায় জাল টাকা বিক্রি পেজ। এছাড়া টেলিগ্রামে ‘জাল টাকা’, ‘জাল টাকার লেনদেন’ এবং ‘জাল টাকা সেল গ্রুপ’ রয়েছে। বাদ যায়নি টেলিগ্রামও। টেলিগ্রামে দেখা যায়, ‘জাল টাকার লেনদেন’, ‘জাল টাকা (নো অ্যাডভান্স)’, ‘জাল টাকার লেন দেন’, ‘জাল টাকা বাংলাদেশ সার্ভিস’ ও ‘জাল টাকা সেল গ্রুপ’ চ্যানেল।

‘জাল টাকা বিক্রি বাংলাদেশ ডটকম’ পেজের অ্যাডমিন হাসানুজ্জামান আসাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রতিদিনের সংবাদ। হাসানুজ্জামান জানান, ‘সারা বাংলাদেশের হোম ডেলিভারিতে দিচ্ছেন জাল টাকা। যারা নোট নিতে ইচ্ছুক, তারা ইনবক্সে আসে। আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণ নোট আছে ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০, ১০০০ টাকার। সুপার কোয়ালিটি মানসম্পন্ন নোট দিচ্ছি একমাত্র আমরাই। যারা বারবার প্রতারিত হচ্ছেন, তারা লাস্ট একবার আমাদের কাছে থেকে কিনতে পারেন। সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা নিতে হবে। এক টাকাও অগ্রিম দিতে হবে না, শুধু ডেলিভারি চার্জ দেবেন, বুকিং দিয়ে রিসিভ পাঠিয়ে দেব।’

টাকার দাম জানতে চাইলে হাসানুজ্জামান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমান আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণ মাল (জাল টাকা) স্টক আছে। ১০০ টাকার নোট ১ লাখে দিতে হবে ১২ হাজার টাকা। ৫০ টাকার ১ লাখে লাগবে ১৫ হাজার টাকা। ২০০ টাকার ১ লাখ নোটের দাম ১০ হাজার টাকা। ৫০০ টাকার ১ লাখ নোটের দাম ৯ হাজার এবং ১ হাজার টাকার ১ লাখ নোটের দাম মাত্র ৭ হাজার টাকা। সরাসরি নিতে পারবেন রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে। আজ যদি আপনি অর্ডার করেন, তাহলে কাল পেয়ে যাবেন।’

অনলাইনে এসব টাকা বিক্রির হাট ঘেঁটে দেখা যায়, ১ লাখ টাকার জাল নোট পেতে সব মিলিয়ে খরচ করতে হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। তবে সেই ১০ হাজার টাকা একবার দিতে হয় না। প্রথম ধাপে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা অগ্রিম পাঠালেই দুদিনের মধ্যে কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয় লাখ টাকার জাল নোট। সেগুলো হাতে পাওয়ার পর বাকি টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। তবে বেশি পরিমাণে নোট অর্ডার করলে অগ্রিম টাকা কম দিলেও চলে। ২ লাখ টাকার জাল নোটের জন্য অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা।

সূত্র বলছে, বড় নোটের চেয়ে ছোট নোটের চাহিদা বেশি। কারবারিরা ১০, ২০, ৫০, ১০০ ও ২০০ টাকার নোট বেশি জাল করছেন। এসব নকল এ টাকা করতে টিস্যু পেপার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কালি ব্যবহার করছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সম্প্রতি এ চক্রের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তারা জাল টাকা বিক্রির জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করছেন। এ চক্রগুলো জাল টাকা তৈরি করে নির্দিষ্ট কয়েকজন সদস্য দিয়ে আসল টাকার ভেতর জাল টাকা মিশিয়ে মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবন বিষিয়ে তুলছে।

জাল টাকা বিক্রি নামের ফেসবুক পেজে আরাফাত নিলয় নামে একজন পোস্টে লেখেন, ‘এখানে সবাই বাটপার। আগে বলবে অ্যাডভান্স ছাড়া মাল দেব, কিন্তু পরে বলবে কুরিয়ার খরচ দিতে হবে। ওটা নিয়ে বলবে, কুরিয়ারে দিলে ঝামেলা হবে তাই হোম ডেলিভারিতে দেব, তার খরচ দিতে হবে ৫১০ টাকা। এরপর টাকা পাঠাইছি কোনো মাল পাইনি। সব বাটপার।’ ‘জাল টাকা বিক্রি করি’ নামের একটি ফেসবুকে পেজে জাল নোট বিক্রির পোস্ট দেওয়া হয়। ওই পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “পবিত্র ঈদ সামনে রেখে নিখুঁত ও মসৃণ প্রিন্টসহ সম্পূর্ণ ‘এ’ গ্রেডের প্রোডাক্ট (জাল নোট) পাওয়া যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কুরিয়ার ও হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও রয়েছে।”

র‌্যাব বলছে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে জাল টাকা বেচাকেনার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন তারা। এসব পেজ প্রমোট, বুস্টিং করে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা সংগ্রহ করেন, যারা রমজান ও ঈদুল ফিতর টার্গেট করে জাল নোটের ব্যবসায় লিপ্ত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর কদমতলী, ডেমরার বিভিন্ন মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকার কারখানার সন্ধান মেলে। এছাড়া লালবাগ, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোটের কারখানায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে অর্ধশতাধিক গ্রুপ। এর বাইরে আছে আরো অর্ধশতাধিক জাল টাকার ডিলার। প্রত্যেক ডিলারের সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচ-ছয়জন বাজারজাতকারী আছেন।

সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক গ্রুপ জাল টাকা তৈরি ও বিপণনে জড়িত। প্রতিটি উৎসবের আগে জাল নোট তৈরির চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। জাল টাকা তৈরি ও বিপণনের কাজে জড়িত চক্রের সদস্যরা তিন ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি করে, অন্য গ্রুপ টাকার বান্ডিল পৌঁছে দেয়, আরেক গ্রুপ এসব টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়। ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, বেশিরভাগ জাল নোটের কারবারি ঢাকা শহরে বাসা কিংবা অফিস ভাড়া নিয়ে জাল নোট তৈরি করে। বাসা ভাড়া দেওয়ার আগে মালিকের উচিত প্রত্যেকের এনআইডি কার্ডের কপি সংগ্রহ করে নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়া। এছাড়া বাসা ভাড়া নেওয়ার পর ভাড়াটিয়া কী কাজ করছে, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। সন্দেহজনক কিছু হলেই পুলিশকে খবর দিতে হবে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বলেন, যারা ঈদকে কেন্দ্র করে জাল টাকা তৈরি করার পরিকল্পনা করছে, তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া যারা জাল নোটের কারবার করে এরই মধ্যে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের ওপর বিশেষ নজরদারি রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদে গরুর হাটে জাল টাকা শনাক্ত করার মেশিন থাকছে। আমাদের টিমকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া আছে। র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক অনলাইনে নজরদারি করছে। অনলাইনে জাল নোট বিক্রি ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে র‌্যাব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close