reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

স্টার এজেন্ট ও সফল উদ্যোক্তা ফয়সাল

ফয়সাল আহমেদের জন্ম সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশঘেঁষা হলহলিয়া গ্রামে। সেই মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশঘেঁষা জয় বাংলা বাজারেই তিনি এখন কর্মরত। মোবাইল ব্যাংকিং যেমন : বিকাশ এজেন্ট, নগদ এজেন্ট, রকেট এজেন্ট, ফ্লেক্সিলোড এবং পাশাপাশি শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিসসহ বাচ্চাদের যাবতীয় পোশাকের একটি বস্ত্র বিতান রয়েছে তার। সম্প্রতি তিনি ‘বিকাশ এজেন্ট’ ব্যবসায়ী হিসেবে ‘স্টার এজেন্ট’ এবং ‘নগদ এজেন্ট’ ব্যবসায়ী হিসেবে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে সনদ অর্জন করেন। কিন্তু তার এই অর্জনে শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত জীবনের এই সময়টায় রয়েছে নানা রকমের হৃদয়কাড়া গল্প। যেই গল্প পড়ে বর্তমান সময়ের তরুণরা অনুপ্রেরণা পাবে, পাবে অনেক দিকনির্দেশনা। শিক্ষণীয় সেই গল্প শোনাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আজিজ ওয়েসি

‘বাবার স্বপ্ন ছিল আলেম হিসেবে গড়ে তোলা। সে জন্য আমাকে মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছিলেন। পড়াশোনায় আমি অনেক ভালো ছিলাম। আমার হাতের লেখাও অনেক সুন্দর ছিল। সে জন্য ক্লাসের মধ্যে মাদরাসার শিক্ষক নিয়মিত আমার প্রশংসা করতেন। সব সময় বলতেন আমি অনেক বড় আলেম হতে পারব। বার্ষিক পরীক্ষায়ও আমি সর্বদা প্রথম স্থান অধিকার করে মেধার পরিচয় দিতাম। পড়াশোনাও আমার অনেক ভালো লাগত। এ জন্য আমি নিয়মিত ক্লাসে যেতাম। সকাল-বিকেল নিয়মিত পড়াশোনা করতাম। ক্লাসের পড়া সব সময় পরিপূর্ণভাবেই শিখতাম। এজন্য শিক্ষকও নিয়মিত আমার প্রশংসা করতেন। আর আমারও পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ বাড়তে থাকে।

আমার পরিবার ছিল অনেক বড় পরিবার। পরিবারে আমরা পাঁচ ভাই এবং পাঁচ বোন। বড় ভাই পরিবার থেকে আলাদা ছিল। আর বড় বোনেরও বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে জন্য বাবা-মাসহ আমাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা ছিল দশজন। আমার বাবা একজন কৃষক এবং মা একজন গৃহিণী। সে জন্য আমাদের পরিবারে আয়ের কোনো উৎস ছিল না। কারণ আমিসহ আমার সব ভাইবোন পড়াশোনায় ছিলাম। জমি থেকে আমরা যে ফসল পেতাম তা দিয়ে আমাদের ভরণপোষণ হলেও আর্থিক কোনো আয় ছিল না। সে জন্য পরিবারকে অনেক কষ্টে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। তিনবেলা ভাতের অভাব না হলেও তরকারির অভাব ছিল বড্ড বেশি। এজন্য বড় ভাই আব্দুল কাদিরকেও পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু সাংসারিক অভাব ছিল এক মানবেতর জীবনযাপনের মতো। বাবাও তখন বয়সে প্রায় বৃদ্ধ। তাই কাজের মানুষ নেই বললেই চলে।

এমন পরিস্থিতিতে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমরা বাকি তিন ভাইয়ের মধ্যে একজনকে পড়াশোনা ছাড়তে হবে। পড়াশোনা ছাড়তে বলার কারণ আয়-রোজগার করা। কারণ পরিবারের সদস্যরা তখন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছিল। তাই বাবা যখন আমাকে বললেন পড়াশোনা ছাড়ার জন্য, আমি বাবার কথার অবাধ্য হতে পারলাম না। আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিলাম। কারণ আমি নিজ চোখে পারিবারিক অবস্থা দেখছিলাম। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে ছিলাম। তারপর পড়াশোনা ছেড়ে আমি কাজ করে আয়-রোজগার করার জন্য মনোযোগ দিলাম। শুরুতে আমি যেহেতু বয়সে ছোট ছিলাম, তাই আমি সঙ্গী খোঁজে নিলাম। যার কাজের প্রতি নেশা আছে। সেই সঙ্গীকে নিয়ে গ্রামের পাশের নদীতে বর্ষাকালে মাছ ধরে, সেই মাছ বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। মাছ বিক্রির টাকা এনে মায়ের কাছে দিতাম। সেই টাকা দিয়ে তরিতরকারি কেনা হতো। এভাবেই যাত্রাটা শুরু।

কিন্তু যখন বর্ষার মৌসুম শেষ হয়ে গেল তখন মাছ ধরার সুযোগও বন্ধ হয়ে গেল। তাই আমি ভিন্ন কাজের সন্ধান করি। পড়াশোনার প্রতি যেমন আমার অনীহা ছিল না, কাজের প্রতিও আমি সে রকমই ছিলাম। যেহেতু আমার বাড়ি মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে, তাই সেখানে কাজেরও অভাব ছিল না। কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশে কয়লা আমদানি করা হতো এখান দিয়ে। যারা কয়লা আমদানিকারক ছিল তাদের বিভিন্ন ধরনরে কর্মী প্রয়োজন হতো। কারণ ট্রাকে করে কয়লা আসত বাংলাদেশে। সেই কয়লা আবার নৌকাযোগে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জয়গায় রপ্তানি করা হতো। সে জন্য কয়লা আমদানি রপ্তানি ইত্যাদি কাজের জন্য বিভিন্ন কর্মী প্রয়োজন হতো। আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমিও সেই কাজে অংশ নিতাম। ৩০০ টাকার বিনিময়ে সারা দিন হাজিরা দিতাম। সারা দিন হাজিরা দেওয়ার জন্য ভোর ৫টায় বের হতে হতো। আবার বাসায় আসতে সন্ধ্যা ৭টা, ৮টা বা কখনো কখনো রাত ৯টাও বেজে যেত। এভাবেই চলল কিছুকাল। আবার কোনো কোনো দিন এই ৩০০ টাকার বিনিময়ে সারা দিন হাজিরা দেওয়ার কাজটিও পেতাম না। তখন বিভিন্ন কয়লা আমদানিকারক মালিকের ডিপোর পাশে গিয়ে কাজ খোঁজতাম। কখনো পেতাম কখনো পেতাম না। মাঝে মাঝে বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে গিয়েও কাজ করেছিলাম। এই কাজটি করতাম যেদিন বর্ডার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকত সেদিন। এভাবে কাজ পেলে করতাম, না পেলে ফিরে আসতাম। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কখনো কাজে অবহেলা করিনি। কাজ না পেলেও হাল ছাড়িনি। পরের দিন আবার বের হতাম। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই কাজ পেতাম। দিনশেষে যে টাকা পেতাম তা এনে মায়ের কাছে দিতাম।

পারিবারিক পরিস্থিতি আর আমার কাজে যাওয়া, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় তখন আমাকে ধীরে ধীরে ভাবাতে শুরু করল। আমি তখন জীবনের মানে বুঝতে শুরু করলাম। বুঝতে শুরু করলাম জীবন কোনো পুষ্পশয্যা নয়। জীবন এক যুদ্ধের নাম। এই যুদ্ধ সেই যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ হলো কাজ করে পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানো। তাই যত কষ্টই হতো প্রতিদিন কিছু না কিছু টাকা উপার্জন করার চেষ্টা করতাম। এভাবে কাজ করে উপার্জন করে আল্লাহর রহমতে কিছু আয় হলে বাবা আমাকে একটা ফল বিক্রির দোকান করে দেন। প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাদাঘাট বাজার। সেখান থেকে হেঁটে গিয়ে বিভিন্ন ফল যেমন আপেল, আঙুর ইত্যাদি কিনে এনে জয় বাংলা বাজারে আমি বিক্রি করতাম। এভাবে ফল বিক্রি করে অনেক দিন পার করি। এই জয় বাংলা বাজারে আবার আমার বড় ভাইয়ের (যিনি পরিবার থেকে আলাদা ছিল) একটি বস্ত্র বিতান ছিল। হঠাৎ তার দোকানে একজন কর্মচারী প্রয়োজন হলো। সেই সুবাদে তিনি আমাকে নিতে আগ্রহী হয়ে বাবার কাছে বললেন। বাবাও রাজি হলেন। তখন থেকে আমার জীবন একটা নতুন মাত্রা নিতে শুরু করে।

আমি প্রথমে বস্ত্র বিতান পরিচালনা করার জন্য সব নিয়মকানুন শিখে নিই। বেচাকেনা সম্পর্কেও শিখতে শুরু করি। এই শিক্ষাটা আমার জন্য একটা প্রশিক্ষণের মতো ছিল। যেখানে প্রশিক্ষক আমার বড় ভাই। তবে এটা শিখতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ আমি প্রথমত কাজের প্রতি কোনো অবহেলা করিনি। দ্বিতীয়ত ফলের ব্যবসা থেকে হিসাবের ব্যাপারেও ছিলাম সতর্ক। কাস্টমারের সঙ্গে দর-কষাকষিও করতে পারি ভালো। সবকিছু মিলিয়ে ছয় মাসের মধ্যে ট্রেইনিং শেষ হয়ে যায়। এই ট্রেইনিংয়ে শুধু পোশাক কেনাবেচা করাই শিখিনি, শিখেছি বিকাশ, নগদ, রকেট এজেন্ট পরিচালনা করাটাও। আমার বড় ভাই তখন আমাকে বার্ষিক বেতনভুক্ত হিসেবে চুক্তি করে ফেলেন। বাবার সঙ্গে করা সেই চুক্তি অনুযায়ী শুরুতে আমি ৩৬০০০ টাকা বেতনে বার্ষিক কর্মচারী ছিলাম। চার বছর পর তা ৫০০০০ টাকায় উন্নীত হয়। এভাবে ছয় বছর কর্মচারী হিসেবে কাজ করার পর আমার মনে হলো, এখন আমি নিজেই একটা বিজনেস পরিচালনা করতে সক্ষম হব।

তারপর বাবা-মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে বড় ভাইয়ের দোকানের পাশেই একটা বস্ত্র বিতান দিই। যেখানে শাড়ি, লুঙ্গি, শার্ট, প্যান্ট, থ্রি পিসসহ বাচ্চাদের যাবতীয় পোশাকের ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি বিকাশ এজেন্ট, নগদ এজেন্ট, রকেট এজেন্টে লেনদেন শুরু করি। ধীরে ধীরে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। আমি নিজেই ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকি। এভাবে চার বছর ব্যবসা পরিচালনা করার পর ‘বিকাশ’ থেকে আমাকে উপজেলার অন্যতম ‘স্টার এজেন্ট’ বা ‘এজেন্ট তারকা’ এবং ‘নগদ’ থেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে মনোনীত করে সনদ প্রদান করেছেন। এতে আমি অনেক আনন্দিত। বিকাশ ও নগদের প্রতি আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মহান আল্লাহর নিকট আমি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। কারণ এখন আমি আমার বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হয়েছি। আল্লাহর রহমতে আমার পরিবারে এখন আর কোনো অভাবের অভিযোগ নেই। আমি এখন ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে সক্ষম হয়েছি। আল্লাহর রহমতে এখন আমি সুখী। কারণ এখন আমি একজন উদ্যোক্তা।

তরুণ যারা পড়াশোনা করেনি কিন্তু এখনো বেকার তাদের উদ্দেশে আপনার কী বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মনে করি সেই যেই হোক বসে না থেকে কাজে লেগে পড়া। কাজ করতে করতেই অভিজ্ঞতা অর্জন হবে। কাজে নেমে পড়লেই নতুন কাজের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই অবহেলা না করে কাজের খোঁজে ঘর থেকে বের হতে হবে। কাজের কোনো অভাব নেই। তাই অবহেলায় জীবন অতিবাহিত না করে কাজে নেমে পড়লে একদিন না একদিন সফলতা আসবেই, আসবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close