অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

  ১১ জানুয়ারি, ২০২৪

ভরা মৌসুমেও চড়া সবজি

বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম কমছে ক্রমাগত, কিন্তু বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র। দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম। এমনকি শীতের এ ভরা মৌসুমে বাজারে পর্যাপ্ত সবজির সরবরাহ থাকলেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং ক্রমাগত চড়ছে সবজির দাম। এমনকি নির্বাচনের পর আরেক ধাপ বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। গতকাল বুধবার ও আগের দিন মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। এসবের জন্য বরাবরই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন সাধারণ মানুষ। জনসাধারণের এ ক্ষোভের কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বা বাজার মনিটরিংয়েও কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। ফলে অসহায় মানুষের ক্ষোভ দিন শেষে পরিণত হচ্ছে নিষ্ফল আস্ফালনে।

সরেজমিন বুধবার রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরের কাঁচাবাজারে দেখা যায়, প্রতি কেজি শিম প্রকারভেদে ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া চিচিঙ্গা, ঝিঙা ও বরবটি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬০-৮০ টাকা। প্রতিটি ফুলকপি ৪০-৮০ এবং বাঁধাকপি ৪০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচাবাজারে আসা ক্রেতাদের একজন সরোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে সবজির দামে কিছুটা লাগাম থাকলেও এখন ইচ্ছামতো লাফ দিচ্ছে। সব জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রয়োজন অনুসারে সবজিও কিনতে পারছি না।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নাইটগার্ডের দায়িত্ব পালন করা এ ক্রেতা বলেন, আমাদের সমস্যা দেখার কেউ নেই। বলা হয়, বাজারে সরবরাহ সংকট, তাই দাম বাড়তি। কিন্তু দেখুন, বাজারে সব জিনিসই আছে, প্রচুর আছে। এরপরও দাম কমছে না। সরোয়ার হোসেনের অভিযোগ, আসলে সবকিছু চলছে অতিমুনাফা লোভী ব্যবসায়ীদের ইচ্ছামতো। দেশের মানুষকে জিম্মি করে তারা এখন সুদখোরদেরও হার মানিয়েছে।

প্রায় একই কথা বলেন রাজধানীর কারওয়ানবাজারে আসা একটি বেসরকারি বীমা কোম্পানির জুনিয়র কর্মকর্তা উম্মে হানি লিজা। তিনি বলেন, এক মাস আগেও ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনেছি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায়। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। হঠাৎ করে সেই দাম প্রতি কেজি ১৫০ টাকায় ঠেকল। এরপর আবার কিছুটা কমে এখন ৮০-১০০ টাকায় চলছে। এগুলো কি সরকার দেখে না। যে যার ইচ্ছামতো দেশের মানুষকে নিঃস্ব করে নিজেরা হাজার কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, আজ একটা জিনিসের দাম বাড়ছে তো কাল আরেকটার। নতুন আলু কিনতে হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা। কয়েকদিন আগেও গোল বেগুন কিনেছি ৪০-৫০ টাকায়, এখন সেটা ৮০ টাকা। আমরা যাব কই?

এদিকে বাংলাদেশে সবজিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়লেও বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম প্রতিনিয়ত কমছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে ১৩.৭০ শতাংশ। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশে খাবারের দাম ১০.০৬ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

এফএওর খাদ্য মূল্যসূচক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর (পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট) পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে ১০.১০ শতাংশ। এ সময় শুধু চিনি ছাড়া সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। তবে একই সময়ে বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি (পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট) জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন ৭.৭৬ শতাংশ থেকে আগস্টে সর্বোচ্চ ১২.৫৪ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে কখনো ১০.০৬ শতাংশের কম ছিল না। মূলত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যেই সরকারের নানা পদক্ষেপেও খাদ্যপণ্যের দাম কমানো যায়নি।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য খাদ্যের বাড়তি দাম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, ভুটান ও নেপালে বছরজুড়ে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কম ছিল। অবশ্য সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এটা স্বীকার করেছে। সরকারি সংস্থাটির তথ্যমতে, গত এক বছরে শুধু চাল ও আটা-ময়দার দাম কমেছে। অন্যদিকে ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, আলু, ডিমসহ মসলা, মাছ, মাংসের দাম বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩ সালের পুরোটা সময়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল সরকার। এ সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিশেষত ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে কষ্টে ছিল সাধারণ মানুষ। নিকটাতীতের এতটা অস্থিতিশীলতা কখনো দেখা যায়নি। অনেকে বাধ্য হয়ে কমিয়ে দিয়েছেন খাবার গ্রহণ। অনেক পরিবার বছরজুড়েও মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের চাহিদা মেটাতে পারেনি। মূলত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকাকেই এজন্য দায়ী করে সেন্ট্রাল ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ নিয়ে গত বছরের মাঝামাঝি একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে সংস্থাটি।

খাদ্যপণ্যের এমন ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বাজারে যেটা হচ্ছে সেটা ব্যবসা নয়, ভোক্তাকে জিম্মি করে ডাকাতি। তার মতে, বাজারে নজরদারির ঘাটতির কারণেই এমনটা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সরকারের কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছে। যেসব পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেগুলো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close