ভারতে রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদের জয়জয়কার
ভারতে এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দেশ-বিদেশি অনেক সংবাদমাধ্যম একে হিন্দুত্ববাদের পরাজয় হিসেবে দাবি করছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি সেরকম নয়।
ভারত স্বাধীণ হওয়ার পর এই প্রথম দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় কোনো মুসলমান মন্ত্রীর স্থান হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয়টি পেয়েছিলেন দুজন মুসলিম এমপি। ২০১৪ সালে নাজমা হেপতুল্লাহ এবং ২০১৯ সালে মুখতার আব্বাস নাকভি। কিন্তু এবার কেউ নেই।
ভারতে ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন থেকে মুসলমান এমপির হার ৫ শতাংশের নিচে যায়নি। তবে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার কারণে মুসলমান এমপির হার ৪ দশমিক ৬৬ এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিবারই ভারতে মুসলমান এমপির সংখ্যা লোকসভায় ছিল ৫ শতাংশের ওপরে। কংগ্রেসের আমলেও লোকসভায় মুসলমান প্রতিনিধির হার সব সময়েই ঘোরাফেরা করেছে ৫ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে, এমনকি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর প্রধান প্রবক্তা জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে এই হার দ্রুত কমতে শুরু করে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে লোকসভায় মুসলমান জনপ্রতিনিধিত্ব গড়ে দেড় শতাংশ কমে গিয়েছে।
প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে সব দল
২০১৪ সালে মোট ৩ হাজার ২৪৫ প্রার্থীর মধ্যে ৩২০ জন, অর্থাৎ ৯ দশমিক ৯ শতাংশ মুসলমান ছিলেন বলে ‘মেজরিটেরিয়ান স্টেট’ বইতে লিখেছেন ফরাসি অধ্যাপক ও ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস্টোফ জেফ্রোলে। ভারতের নির্বাচনে প্রার্থী বিশ্লেষক সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস জানিয়েছে, ২০২৪ সালে অন্তত ৮ হাজার ৩৩৭ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, যার মধ্যে মুসলমান প্রার্থীর সংখ্যা ৭৮, অর্থাৎ শূন দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর অর্থ হলো ভারতে গত ১০ বছরে মুসলিম প্রার্থীর হার ৯ দশমিক ৯ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৯৩ হয়ে গিয়েছে।
ওপরের তথ্য থেকে পরিষ্কার, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো বিজেপি বা হিন্দুত্বের ভয়ে মুসলমান প্রার্থী দেওয়া অসম্ভব হারে কমিয়ে দিয়েছে। যেমন কংগ্রেস ২০১৯ সালে দিয়েছিল ৩৪ জন, এবারে দিয়েছে ১৯। তৃণমূল কংগ্রেস তেরো থেকে নেমেছে ছয়ে, সমাজবাদী পার্টি আট থেকে চারে, লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল পাঁচ থেকে দুইয়ে এবং বিজেপি তিন থেকে একে। তবে বিজেপি দু-একজনের বেশি মুসলমান প্রার্থী কোনোবারই দেয় না, এবারও দেয়নি।
ভারতে ২০১১ সাল থেকে মুসলমান জনসংখ্যার হার ১৪ দশমিক ২, অর্থাৎ ১৭ কোটির কিছু বেশি। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে সেন্সাস বা আদমশুমারি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় না, ফলে এ সংখ্যা সম্ভবত আরও বেড়ে থাকতে পারে। মুসলমান সমাজ জনসংখ্যার অন্তত ১৪ দশমিক ২ শতাংশ হলেও এবার তাদের লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। যাবতীয় তথ্য প্রমাণ করে, মুসলমান সমাজের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ দ্রুতগতিতে কমছে।
এর অর্থ, ২০২৪ সালে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও ভারতের রাজনীতির ‘প্লুরালিস্ট’ বা বহুত্ববাদী চরিত্র হারিয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কাঠামো প্রতি নির্বাচনেই শক্তপোক্ত হচ্ছে। ওপরের পরিসংখ্যানই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
পিডিএস/এমএইউ