ফরিদুল ইসলাম নির্জন
সাক্ষাৎকার
একজন লেখক রাষ্ট্রের অস্বীকৃত অ্যাম্বাসাডর : সাইয়েদ জামিল
সাইয়েদ জামিল। কবি, গীতিকার, শিশুসাহিত্যিক এবং গবেষক। জন্ম ১৫ মে ১৯৮৬, কুষ্টিয়ায়। পড়াশোনা বাংলা ভাষা, সাহিত্যে স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই ১৮টি। সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রভাবনা আর মানবতা তার লেখার অন্যতম উপস্থাপন। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু। পরে যুক্ত হয়েছেন পর্যটনশিল্পে। প্রতিষ্ঠা করেছেন গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব পলিটিকো অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার। সম্প্রতি শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হয়েছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন
শুরুতেই জানতে চাই আপনি কেমন আছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর সাধারণত দিই না। যদি বলি ভালো আছি, তবে তা কেমন ভালো কিংবা তা কীসের সাপেক্ষে— এই রকম প্রশ্ন আসতে পারে। তেমনি খারাপ আছি বললে, কেমন খারাপ আর তা কীসের সাপেক্ষে— সেটাকেও সামনে আনতে হয়। ফলত আমি ভালো এবং খারাপ ব্যাপারটাই এড়িয়ে যাই। সর্বদা আনন্দে থাকার চেষ্টা করি।
বর্তমানে কী পড়ছেন বা লিখছেন?
বর্তমানে পড়ছি মুসা আল হাফিজের দুটি বই। একটি চিন্তা ও দর্শনের বই। নাম ‘ঐন্দ্রজালিক আত্মজীবনী’। অন্যটি কবিতার। নাম ‘ইভের হ্রদের মাছ’। ঐন্দ্রজালিক আত্মজীবনী খুবই চমৎকার একটি বই। পড়ে খুবই আরাম পাচ্ছি। কবিতার বইটিও সুখপাঠ্য। লিখছি দুটি কবিতার বই। একটির নাম ‘খুনি রাষ্ট্রের বুকের ওপর লেখা কবিতা’। এটি সামনের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হবে। অন্যটির নাম ‘যদি তুই কবি হোস তবে তুই ধাক্কা খা সংবিধানের সাথে’।
আপনার প্রিয় কবি কারা? যাদের কবিতা পড়ে আপনার জীবনবোধ পাল্টে গিয়েছে?
আমার কোনো প্রিয় কবি নেই। তবে দেশ-বিদেশের বহু কবির কবিতায় আমি আলোড়িত হয়েছি। কবিতা নয় শুধু— উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, দার্শনিক রচনা, রাজনৈতিক থিওরি, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়-আশয় দ্বারা আলোড়িত হয়েছি। পরিবর্তিত হয়েছি। আমার জীবনবোধে আমার সব ধরনের পঠনপাঠনের ভূমিকা আছে।
কী কারণে তিনি বা তারা আপনার প্রিয় কবি?
কারণ একটাই— তাদের চিন্তা আমাকে আলোড়িত করে। তাদের দেখার জগৎ আমার অনুভরে ধরা দেয়। ফলে আমি শিখতে শিখতে প্রতিনিয়ত পাল্টে যেতে পারি। মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত পাল্টে যেতে চাই এবং আপডেট হতে চাই। পাল্টানোর সূত্র যিনি ধরিয়ে দিতে পারেন, যার রচনায় পাল্টানোর ঈঙ্গিত থাকে সে তো প্রিয়ই হবে।
আপনার লেখা আপনার সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটি?
এইটা একটা বিব্রতকর প্রশ্ন এবং একই সঙ্গে যথেষ্ট জটিল। নিজের বই থেকে একটা প্রিয় বাছাই করা দুরূহ ব্যাপার। তবু একটা যেহেতু করতেই হবে সেহেতু ‘কায়কাউসের ছেলে’-এর কথাই বলব।
বইটি লেখা থেকে শুরু করে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত জার্নিটা জানতে চাই।
বইটি লিখেছিলাম খ্রিস্টাব্দ ২০১৩-২০১৪ সময়কালে। ২০১৩-তে আমার প্রথম বই ‘রাষ্ট্রবিরোধী গিটার’ প্রকাশিত হয়। এরপর চিন্তা করলাম, একটি নতুন ভাষাভঙ্গির দিকে যাওয়া চেষ্টা করা দরকার আমার। একই সঙ্গে বিষয়েও প্রথাগত জায়গা থেকে সরে আসার চেষ্টা করলাম। এভাবে ৪০টি নতুন কবিতা লিখে ফেললাম। পাণ্ডুলিপি ঠিকঠাক প্রস্তুত হয়ে গেলে এক দিন আর্টিস্ট নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের অনুপ্রেরণায় সেটি জমা দিই ‘প্রথমা’-এর জীবনানন্দ পুরস্কারের জন্য। জীবনে এই একবারই প্রথম এবং শেষবার কোথাও পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার ঘটনা ঘটাই। অপ্রত্যাশিতভাবে কায়কাউসের ছেলে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। সেটা ২০১৫-এর জানুয়ারিতে। এরপর ঘটনা সুখকর নয়। নানা বিতর্ক ঘিরে ধরে আমাকে। বইটির অংশবিশেষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর বিরুদ্ধে প্রথাগত পাঠক এবং অপাঠক শ্রেণি অশ্লীলতার অভিযোগ তোলেন। অবস্থা এতই বেগতিক হয়, একপর্যায়ে এই পুরস্কার বাতিলের ঘোষণা দেয় প্রথমা। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার জন্য পুরস্কারটি বাতিল করা হলো।’ পুরস্কার বাতিল হলে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ পুরস্কারসংক্রান্ত কারণে বইটির প্রকাশনা আটকে ছিল। এরপর দ্রুত, সম্ভবত ঘটনার তিন দিন পরই বইটি প্রকাশিত হয়।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হয়েছেন। এটা নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত পরিকল্পনা কী?
এটা নিয়ে আসলে ব্যক্তিগত পরিকল্পনার সুযোগ নেই বললেই চলে। অনেকের সঙ্গে মিলে মতামতের ভিত্তিতে কাজ করতে হয়। আমি চেষ্টা করব শিল্পীদের যাতে কোনো ধরনের অসম্মান না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে। শিল্পীদের যে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়, তার আকার বাড়াতে মত দেব। এ ছাড়া ট্রাস্টের অধীনে একটি আর্টিস্ট মিউজিয়াম করার প্রস্তাব করব।
লেখালেখির ক্ষেত্রে পারিবারিক সাপোর্ট কেমন পান?
এ ক্ষেত্রে আমি সৌভাগ্যবান। অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, লেখালেখির ক্ষেত্রে পারিবারিক কোনো সাপোর্ট পান না। বরং নানা গঞ্জনার শিকার হন। আমার ক্ষেত্রে উল্টা। পারিবারিক সাপোর্টের ওপরই টিকে আছি। আমি পেশামুক্ত মানুষ। পরিবার আমাকে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ দিয়েছে। তা ছাড়া পরিবারে আমার মতামতের গুরুত্বও ঢের। আমি কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সর্বসম্মতভাবে দ্রুত তা বাস্তাবায়ন করা হয়।
লিখছি দুটি কবিতার বই। একটির নাম ‘খুনি রাষ্ট্রের বুকের ওপর লেখা কবিতা’। এটি সামনের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হবে। অন্যটির নাম ‘যদি তুই কবি হোস তবে তুই ধাক্কা খা সংবিধানের সাথে’
লেখালেখির ক্ষেত্রে একজন লেখক রাষ্ট্রের জন্য কী ভূমিকা রাখতে পারেন?
বিবিধ ভূমিকা রাখতে পারে। একজন লেখক হলেন রাষ্ট্রের অস্বীকৃত অ্যাম্বাসাডর এবং জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার দিশারি। লেখক তার ভাষা, চিন্তা ও অপরাপর তৎপরতা নিয়ে মানুষের কাছে হাজির থাকেন। এ ছাড়া একজন লেখক সাহিত্যের মাধ্যমে নিজের দেশকে সারা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে পারেন। পারেন রাষ্ট্রের মর্যাদা বাড়াতে।
একজন কবি হিসেবে আপনি কি মনে করেন কবি বা লেখকের কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকা উচিত? যদি উচিত হয় ব্যাখ্যা করেন।
কবি নিজেই একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ। রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য কেবল রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে হবে বা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় যেতে হয় এমন নয়। পৃথিবীর বহু কবি, লেখক সরাসরি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছেন। নির্বাচন করেছেন। লিওপোল্ড সেদার সেনঘর সেনেগালের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। পাবলো নেরুদা চিলির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন। অবশ্য তিনি বন্ধু সালভাদর আয়েন্দের পক্ষে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলেন পরে। আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম তো রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে আইনসভা নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে কবি বা লেখক রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে থেকেও কাজ করতে পারেন। রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকতেই হবে ব্যাপারটা এমন নয়। আপনি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়লে বুঝতে পারবেন— রাজনৈতিক দলের চেয়েও বড় এজেন্ডা নিয়ে তিনি তার জাতি রাষ্ট্রের সামনে হাজির ছিলেন।
কবিতা সম্পর্কে কেউ কেউ অভিযোগ করেন, পাঠক কমে যাচ্ছে? আসলে কী তাই?
এই অভিযোগ চিরায়ত। কবিতার পাঠক কোন কালে বেশি ছিল বলতে পারবেন? কবিতার পাঠক চিরকালই কম। প্রত্যেক শিল্পমাধ্যমের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। কবিতারও আছে। কবিতা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন একটি শিল্পমাধ্যম। যেহেতু এটি হৃদয়জাড়িত এবং ভাষায় আশ্রয় নেয় সেহেতু এটি যথেষ্ট জটিল একটি শিল্পপ্রয়াস। এই জটিল শিল্প প্রয়াসের কাছে যেতে বহু পথ হাঁটতে হয় মানে এই শিল্পপ্রয়াস অনুধাবনের জন্য একটা প্রস্তুতির দরকার পড়ে। অনেক বেশি মানুষ কবিতা পড়ছে ব্যাপারটা আমি ভাবতেই পারি না। গা ঘিনঘিন করে।
বর্তমানে কার বা কাদের কবিতা ভালো লাগে?
অনেকের কবিতা ভালো লাগে। ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা ভালো লাগে। ভালো লাগে কামরুজ্জামান কামু, ব্রাত্য রাইসু, মারজুক রাসেলের কবিতা। আমাদের জেনারেশনের মধ্যে হিজল জোবায়ের, জব্বার আল নাঈম, পলিয়ার ওয়াহিদ, সালেহীন শিপ্রার কবিতা ভালো লাগে। একেবারে নতুনদের মধ্যে ফরহাদ নাইয়ার কবিতায় আমি চমকিত হই। ভালো লাগে উদয়ন রাজীবের কবিতাও।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্য বা কবিতা নিম্নমানের সাহিত্য মনে করেন কেউ কেউ? আসলে জনপ্রিয় সাহিত্য মানেই কি নিম্নমানের?
জনপ্রিয় সাহিত্য মানেই নিম্নমানের আমি এটা মনে করি না। যারা এমন ধারণা পোষণ করেন, তাদের বিবেচনাবোধে যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। এটা ঠিক অনেক জনপ্রিয় সাহিত্য কালের স্রোতে ভেসে যায়। কিন্তু সবক্ষেত্রে ব্যাপারটা সত্য নয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ বইটা দেখেন। দেবদাস যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন বাংলা ভাষার বহু লেখক এটাকে চটুল সাহিত্য বলেছিল। বলেছিল, এই জিনিস টিকবে না। এখন দেখেন, দেবদাসের বয়স ১০০ পেরিয়ে গেছে। এখনো এই বই প্রচুর বিক্রি হয়। এই বই নিয়ে একাধিক ভাষায় বহু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এই বই ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছিল। অনেক কবি সমালোচক এটিকে অল্পবয়সের উল্লম্ফন বলেছিলেন। আমি আমি সর্বস্য বলেছিলেন। যারা বলেছিলেন তাদের অস্তিত্বই এখন লীন। অথচ নজরুল আর বিদ্রোহী সগর্বে এখনো রাজ্যত্ব করছে। বিদ্রোহী কবিতার বয়সও ১০০ পেরিয়ে গেছে।
অনলাইন সাহিত্যচর্চার একটি মাধ্যম নাকি সময় ব্যয়ের আখড়া। সেটাকে কীভাবে দেখেন? এটি আসলে ব্যবহারকারীর বিবেচনাবোধের ওপর নির্ভর করে। এই মাধ্যম আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরকে মুহূর্তেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হাজির করতে সক্ষম। এর সঠিক ব্যবহার করলে আমাদের সাহিত্য আরো দ্রুত বিভিন্ন পরিসরে ছড়িয়ে যাবে।
ভালো বই নির্বাচনে পাঠকরা কোন বিষয়টি বিবেচনা করবে?
জটিল প্রশ্ন। আমি ঠিক জানি না পাঠক কোন বিষয়টি বিবেচনা করবে। একেকজন হয়তো একেক রকমভাবে বিবেচনা করবে। আমি সাধারণত বইটি উল্টেপাল্টে দেখি। প্রথম পৃষ্ঠা পড়ি। মাঝের কোনো পৃষ্ঠাও একটুখানি পড়ে দেখি। আর ফ্ল্যাপে লেখক সম্পর্কে পড়ি। দেখি যে লেখক নিজের সম্পর্ক কোনো অতিকথন লিখেছে কি না। নিজের সম্পর্কে অতিকথন থাকলে সেই বই আমি সাধারণত কিনি না।
সব শেষে যা বলতে চান?
সব শেষে বলতে চাই— বাংলাদেশের মানুষ আরো বেশি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হোক। আরো বেশি অধিকারসচেতন হোক। এবং হে পাঠক, আপনারা যেকোনো একটি শিল্পমাধ্যমের সংস্পর্শে থাকুন। শিল্পের সংস্পর্শ আপনার জীবনকে বর্ণিল এবং বৈচিত্র্যমণ্ডিত করবে।
পিডিএস/হেলাল