চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি

  ১০ জুন, ২০২৪

চিলমারীতে ধান-চাল সংগ্রহে অনিয়ম

তালিকায় অন্য জেলা, ভুয়া কৃষক ও এসআইয়ের নাম

কুড়িগ্রামের চিলমারীতে সরকারি খাদ্যগুদামে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে লটারি করা কৃষকের নামের তালিকায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তালিকার কৃষকদের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করে ভুয়া, অন্য জেলার বাসিন্দা, এমনকি পুলিশ সদস্যে নাম পাওয়া গেছে। অর্ন্তভূক্ত হয় সে প্রশ্নে প্রকৃত প্রান্তিক কৃষদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

সরকারিভাবে প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে স্বচ্ছভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করতে ডিজিটাল প্রক্রিয়া (অ্যাপস) চালুর পরও ভুয়া নাম অর্ন্তভূক্ত হওয়ায় কৃষদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকদের দাবি, তালিকায় অনিয়মের বিষয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

খাদ্য গুদাম সূত্রে জানা গেছে, চিলমারিতে চলতি বোরো মৌসুমে সরকারি অ্যাপসে আবেদনের ভিত্তিতে লটারির মাধ্যমে প্রতি কেজি ধান ৩২ টাকা দরে ২২৯ জন প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে ৬৮৮ মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। এছাড়া ৪৫ টাকা কেজি দরে উপজেলায় ৪০ জন মিলারের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৬ মেট্রিক টন চাল ও ৩৪ টাকা কেটি দরে ৯০ মেট্রিক টন গম কেনা হবে। গত ৭ মে থেকে শুরু হওয়া এই ধান-চাল সংগ্রহ আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে।

নিয়মানুযায়ী, সরকারের খাদ্য শস্য সংগ্রহের নির্দিষ্ট অ্যাপসের মাধ্যমে উপজেলার প্রান্তিক কৃষকরা আবেদন করবেন। আবেদনের সময় শেষে তাদের তালিকা ধান সংগ্রহ কমিটির সভায় উপস্থাপন ও লটারি করবেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। লটারির মাধ্যমে নির্দিষ্টসংখ্যক কৃষকে বাছাই করে তাদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করা হবে।

তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২২৯ জন কৃষকের তালিকা সাটানো হয়েছে, যারা প্রত্যেকে ৩ মেট্রিক টন করে ধান সরকারি গুদামে দিতে পারবেন।

এদিকে উপজেলা খাদ্যগুদামে টাঙানো তালিকা ধরে উপজেলার থানাহাট, রমনা, রাণীগঞ্জ, নয়ারহাট, অষ্টমীর ও চিলমারী ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত কৃষকদের সঙ্গে মোবাইলে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তারা অনেকেই চিলমারী উপজেলার বাসিন্দা নন বলে জানান।

উপজেলার অষ্টমীর চর ইউনিয়নের বাসিন্দা হিসেবে তালিকাভুক্ত কৃষক মোছা. শাপলা বেগমের নম্বরে ফোন করা হলে তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার আশরাফুল ইসলাম বলে জানান। তার মোবাইল ফোনে ব্যাংক এশিয়া থেকে টাকা-পয়সার এসএমএস (খুদে বার্তা) যাওয়ায় তিনি ঝামেলায় পড়েছেন বলে এ প্রতিনিধিকে জানান।


  • তালিকাভুক্ত জিল্লুর রহমানের ফোন নম্বরে কল দিয়ে মেলে থানার এসআই দিলীপ কুমারকে
  • টাকার বিনিময়ে অন্যের এনআইডি দিয়ে গুদামে ধান জমা
  • প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস খাদ্য শস্য সংগ্রহ কমিটির সভাপতি ইউএনওর

তালিকার মো. রওশন আলীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার বাসিন্দা বলে জানান। একইভাবে তালিকা ভুক্ত থানাহাট ইউনিয়নের কৃষক আমিনুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি খুলনার বাসিন্দা, নয়ারহাট ইউনিয়নের সাদেক হোসেন নিজেকে লালমনিরহাটের বড়বাড়ী এলাকার বলরাম বলে পরিচয় দেন। আব্দুল মালেককে ফোন করা হলে ‘রং নাম্বার’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।

দুর্গম চরাঞ্চলে অবস্থিত ইউনিয়নটির সুবিধাভোগীদের তালিকার ৩৯ থেকে ৪৫ নম্বর ক্রমিকে একই সিরিয়ালের ফোন নম্বরের কেবল শেষ দুুটি সংখ্যা বদল করা হয়েছে। জিল্লুর রহমান নামে আরেকজন তালিকাভুক্ত কৃষকের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি চিলমারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দিলীপ কুমার রায় বলে পরিচয় দেন। অন্য ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও একই অবস্থা দেখা যায়।

উপজেলা খাদ্যগুদামে যোগাযোগ করে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২০ জন কৃষকের কাছ থেকে মোট ৬০ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে।

ধান সংগ্রহের তালিকার ২০ কৃষকের মধ্যে ১৯ নম্বর ক্রমিকে থাকা অষ্টমীরচর ইউনিয়নের মোছা. সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, তারা কোনো জমি চাষ করেননি এবং কোনো গুদামে ধান দেননি। তালিকার চিলমারী ইউনিয়নের মোছা. কমিলা বেগমকে কল দেওয়া হলে আনিছুর রহমান নামে তার এক নাতি ফোন রিসিভ করে গুদামে ধান দেওয়ার কথা জানান। তবে রমনা ইউনিয়নের মো. আলমগীর হোসেন জানান, আহাদ আলী নামের এক ব্যবসায়ী তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার করে গুদামে ধান দিয়েছেন। এ জন্য তিনি দুই হাজার টাকা পেয়েছেন বলে জানান।

উপজেলার রমনা ইউনিয়নের পাত্রখাতা এলাকার কৃষক মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি অ্যাপসের মাধ্যমে আবেদন শুরুর পরের দিন থেকেই অ্যাপসটি বন্ধ। তাই সাধারণ কৃষক আবেদনই করতে পারেনি। এখন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান নেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রকৃত কৃষক হয়েও ধান বিক্রি করতে পারছি না।’

পূর্বমাচাবান্দা এলাকার আমিনুল ইসলাম বীর বলেন, প্রতিবছরই সরকারিভাবে ধান কেনার সময় প্রকৃত কৃষকের বদলে ভুয়া তালিকা দেখিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করেন সংশ্লিষ্টরা। অ্যাপসের মাধ্যমে আবেদন প্রক্রিয়া হলে কীভাবে ‘ভুয়া’ কৃষক অর্ন্তভুক্ত হয়, তা খতিয়ে দেখা জরুরি বলে জানান তিনি। এখন খাদ্য গুদাম ও ধান-চাল ক্রয় সংশ্লিষ্টরা তালিকায় অনিয়মের বিষয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে প্রান্তিক কৃষকদের দাবি।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কুমার প্রণয় বিষাণ দাস বলেন, ‘কৃষকরা অ্যাপসের মাধ্যমে আবেদন করেছিলেন। আমরা উপজেল নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহোদয়কে আবেদন তালিকা সরবরাহ করেছি। তিনি লটারি করেছেন। এ বিষয়ে আমার আর কিছু জানা নেই।’

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো.আলাউদ্দিন বসুনিয়া বলেন, ‘যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরন করে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬০ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। তালিকায় থাকা কৃষকদের মোবাইল ফোন নম্বরে কিছু ভুল লক্ষ করা গেছে, সেগুলো আমরা দেখে ধান নিচ্ছি।’

খাদ্য শস্য সংগ্রহ কমিটির সভাপতি ও ইউএনও মো. মিনহাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে গুম সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। আবারো খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close