জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট

  ০২ অক্টোবর, ২০২২

১৯০০ সাল থেকে অটুট সম্প্রীতির বন্ধন 

লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়িতে একই স্থানে মসজিদ ও মন্দির। ছবি : জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না

সেই ১৮৩৬ সালের কথা। তখন লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়িতে গড়ে উঠে একটি কালী মন্দির। পরবর্তী সময়ে ১৯০০ সালে একই উঠানে নির্মিত হয় মসজিদ ঘর। সেই সময় থেকেই ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধন বহন করে আসছে একই উঠানে মসজিদ ও মন্দির। যে যার মতো ধর্ম পালন করে চলেছেন। এখন এখানে চলছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব।

স্থানীয়রা জানান, ১৮৩৬ সালে কালীবাড়ি বাজারের কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় লালমনিরহাট শহরে কালীবাড়ি এলাকার পুরান বাজার এলাকায় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ধর্মপ্রাণ মুসলমান ব্যবসায়ীরা নামাজ আদায় করার জন্য তার পাশেই একটি ছোট ঘর তোলেন। আর সেটির নামকরণও করা হয় পুরান বাজার জামে মসজিদ হিসেবে। ওই সময় থেকে এক উঠানে চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়ের ধর্মীয় কাজ। পূজা শুরুর আগে মসজিদ ও মন্দির কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নেন। কয়েক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত এখানে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।

জানা গেছে, আজানের সময় থেকে নামাজের প্রথম জামাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের মাইক, ঢাক-ঢোলসহ যাবতীয় শব্দ বন্ধ থাকে। নামাজের প্রথম জামাত শেষ হলে মন্দিরের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। এখানে কোনো বিশৃঙ্খলাও হয় না। ফজরের নামাজ আদায় করে মুসল্লিরা চলে যাওয়ার পর পাশেই মন্দিরে শোনা যায় উলুধ্বনি।

একজন মুসল্লি জানান, পাশাপাশি মন্দির ও মসজিদ দেখতে প্রতিদিন আসেন সাধারণ মানুষ। এমনকি কয়েক দেশের রাষ্ট্রদূতও এই মন্দির ও মসজিদ দর্শন করেছেন। এখানে ধর্ম নিয়ে নেই কোনো হানাহানি ও মতবিরোধ। ফলে সম্প্রীতির এ স্থানটি দেখতে বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময় দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা আসেন এখানে। উভয় ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা যার যার মতো শান্তিপূর্ণ ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়েই পালন করছেন এখানকার মানুষ।

কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি মন্দিরের সভাপতি ও প্রধান পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী জানান, ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এলাকার নামকরণও করা হয় কালীবাড়ি। এরপর মন্দির প্রাঙ্গণেই ১৯০০ সালে একটি নামাজ ঘর নির্মিত হয়। এ নামাজ ঘরটিই পরবর্তী সময়ে পুরান বাজার জামে মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই থেকে এক উঠানে চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়ের কার্যক্রম। সামান্য বিশৃঙ্খলাও হয় না এখানে। জন্মের পর থেকে এভাবে চলতে দেখছেন তিনি।

মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চন্দ্র সাহা বলেন, আমরা মসজিদ ও মন্দির কমিটির সদস্যরা বসে আগেই ঠিক করে নেই কখন এবং কীভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হবে। নামাজের সময়গুলোতে সব ধরনের বাদ্যবাজনা বন্ধ রাখা হয়। নামাজ শেষে মুসল্লিরা চলে যান এবং পূজারিদের জন্য সুযোগ করে দেন। এটাই এখানকার সামাজিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুরান বাজার জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী পুরান বাজার মসজিদের পাশেই একসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠান। মসজিদের আগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবু এখানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ স্বাধীনভাবে ঘুরতে আসেন। আমরা তাদের সব কাজে সহযোগিতা করি। তারাও আমাদের সহযোগিতা করেন। যুগ যুগ ধরে চলছে এ সম্প্রীতির বন্ধন। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। উভয় ধর্মের লোকদের সমসুযোগ দিয়েই এখানে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তাই ধর্ম পালনে কারো কোনো সমস্যা হয় না।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতির এমন নিদর্শন আসলেই বিরল। এখানকার মানুষ সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন। যার প্রমাণ এক উঠানে কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি মন্দির ও পুরান বাজার জামে মসজিদ। এখানকার মানুষের এমন সম্প্রীতির বন্ধন দেখে অভিভূত হয়েছি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মন্দির,লালমনিরহাট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close