এস.এইচ.এম. তরিকুল, রাজশাহী

  ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আউট সোর্সিংয়ে চাকরি দিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণা

ছবি : সংগৃহীত

রাজশাহীতে রাজস্ব খাতভুক্ত আউট সোর্সিং-এ ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বেতনভাতা না দিয়ে ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ নামের ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘ভয়ঙ্কর প্রতারণার’ অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, রাজশাহী সিভিল সার্জনের আওতায় ২০২১-২২ অর্ধবছরের শেষ তিন মাসের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগের যে প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছিল তা গত ৩০ জুন মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এরপরও টাকার বিনিময়ে ওই প্রকল্পেই জনবল নিয়োগ দেয়ার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। সেই সঙ্গে চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে এসব নিয়োগপ্রাপ্তদের দিয়ে মাসের পর মাস বেতন না দিয়েই খাটানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্ধবছরে রাজশাহী সিভিল সার্জনের মাধ্যমে রাজস্ব খাতভুক্ত আউট সোর্সিং হিসেবে অনুমোদিত ৮৬টি পদে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের একটি প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যার প্রেক্ষিতে গত ৩১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক এই অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনঃদরপত্রের মাধ্যমে ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিস’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব জনবল নিয়োগের অনুমোদন পায়। কিন্তু শুরু থেকেই এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ঘুষের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের অভিযোগ ওঠে।

এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত ৩১ মার্চ রাজশাহী সিভিল সার্জনকে পাঠানো আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগের প্রশাসনিক অনুমোদনপত্রে (স্মারক নং- স্বাঃ অধিঃ হিসাব/আউট সোর্সিং জনবল/প্রশা.অনু./সিভিল সার্জন রাজশাহী/২০২১-২০২২/৫৩১) উল্লেখ রয়েছে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ‘আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগ’ এর উন্মুক্ত দরপত্র/চুক্তি প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদানের তারিখ ৩১ মার্চ ২০২২ থেকে কার্যকর হবে। যেটি ৩০ জুন ২০২২ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৩ নভেম্বর ২০২১-এর স্মারক নং ১৩৯৩-এর প্রদত্ত নির্দেশনা মোতাবেক অত্র দরপত্রে প্রশাসনিক অনুমোদনের মেয়াদ বৃদ্ধি করার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য স্থানীয় ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ সিভিল সার্জন কার্যাদেশের মেয়াদ ৩০ জুন ২০২২ অতিক্রান্ত হওয়ার ৬ মাস আগে রাজশাহী সিভিল সার্জন- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্মারক নং- ২২ (২৫ জুলাই ২০২১) এর সংযুক্তি (গ) মোতাবেক তথ্যাদি প্রদানসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পদ সমূহের (৮৬ জন) প্রশাসনিক অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দিয়ে সেবা কার্যক্রম চলমান রাখবেন।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পদে রাজশাহী সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৬ জন জনবল সরবরাহের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় অর্ধেক জনবলকে ঘুষ বিনিময়ে নিয়োগ দেয়। এসব কর্মচারীকে এনআরবিসি ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় একাউন্ট খুলতে বলে।

নিয়ম অনুযায়ী, কর্মচারীরা নিজের নামে সেই ব্যাংকে একাউন্টও খোলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিধিমালা অনুযায়ী নিয়োগকৃতদের মাস শেষে বেতন পরিশোধের কথা থাকলেও ৩০ জুন (প্রকল্পের মেয়াদ) পর্যন্ত কাউকেই বেতন দেয়নি। পরে ২০২১-২২ অর্থবছরের মেয়াদ শেষ হলে কর্মচারীরা বেতনের জন্য চাপ দেয়। তখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের ব্যাংক হিসাবের বহি জমা নেয় এবং প্রত্যেকের থেকে তিন মাসের বেতন দেয়া হবে মর্মে তিনটি চেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো কর্মচারীই তিন মাসের বেতন পাননি।

শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া জনবল নিয়োগের প্রশাসনিক অনুমোদনপত্রে উল্লেখিত মেয়াদ গত ৩০ জুন অতিবাহিত হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত কর্মীদের কোনো বেতন-ভাতা না দিয়েই স্বীয় পদে কর্মরত রাখা হয়েছে। এছাড়া মেয়াদ শেষের পরও প্রতিষ্ঠানটি টাকার বিনিময়ে নতুন করে জনবল নিয়োগ দিয়ে পদায়ন করেছে।

এ বিষয়ে রাজশাহীর তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ১১ এপ্রিল নিরাপত্তা প্রহরী পদে নিয়োগ পাওয়া এনামুল হক বলেন, তারা ৩০ জুন ২০২২ এর পর আমার একাউন্টের চেকবহি জমা নেয়ার পাশাপাশি তিন মাসের জন্য একটি চেকে ৪৩ হাজার ১৩ টাকার স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। চাকরিতে যোগদানের ৬ মাস চলছে অথচ বেতন পেয়েছি মাত্র দেড় মাসের (২১ হাজার টাকা)।

মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কর্মরত মো. গাজিউর রহমান বলেন, কর্মসংস্থান ব্যাংকের নওহাটা শাখায় কর্মরত খাজা মঈনুদ্দিন নামের এক ব্যাংক কর্মকতার সঙ্গে আমার বন্ধু পবার দারুশা কেন্দ্রীয় দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মাহিনুর রহমানের পরিচয় ছিল। এর সূত্র ধরে আউট সোর্সিং-এ চাকরির নেয়ার জন্য আমি ওই ব্যাংক কর্মকর্তা ও তার সহযোগী শিরোইল কলোনী হাইস্কুলের লাইব্রেরিয়ান শিক্ষক লিটন আলীর মাধ্যমে বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসের লোকাল প্রতিনিধিকে গত এপ্রিল মাসে তিন কিস্তিতে নগরীর দড়িখরবোনা মোড়ে গিয়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিই। এরপর আমি ২ মাস ২০ দিন পুঠিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ছিলাম। সেখানে কোনো বেতন পাইনি। পরে গত ১ জুলাই থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমাকে বদলি করেন। কিন্তু এখানেও এখন পর্যন্ত কোনো বেতন দেয়া হয়নি।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যাংক কর্মকর্তা খাজা মঈন উদ্দিন বলেন, আমি গাজিউর রহমানকে চিনি। তখন ঘুষের টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর না দিয়ে বলেন, এখন ব্যস্ত আছি, বিষয়টি নিয়ে সাক্ষাতে কথা বললে ভালো হয় বলে অভিযোগ অস্বীকার করে এড়িয়ে যান।

একইভাবে অভিযোগ অস্বীকার করে নগরীর শিরোইল কলোনী হাইস্কুলের লাইব্রেরিয়ান শিক্ষক লিটন আলী বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এরপর বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পবার দারুশা কেন্দ্রীয় দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মাহিনুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তার ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়ার কথা স্বীকার শিরোইল সাব সেন্টারের (স্বাস্থ্য) আয়া মমতাজ খাতুন বলেন, আমি গত ৫ মে আয়া পদে যোগদান করি। যোগদানের আগে নাটোরের সিংড়া উপজেলার জুয়েল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে শাওনকে (জাকির হোসেন শাওন, বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড, রাজশাহীর কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা) ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। টাকা দিয়ে চাকরি নিয়ে এখন পর্যন্ত পণ্ডশ্রম দিয়েই যাচ্ছি।

এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ রাজশাহীর কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন শাওন বলেন, আমি কোনো নিয়োগ বাণিজ্য করিনি। আমি শুধু আমার ভাগ্নে-ভাতিজাসহ (নিকটাত্মীয়) ৬ জনকে চাকরি দেয়ার সুপারিশ করেছিলাম। যার জন্য আমার ভাগের যে ৪ লাখ টাকা ছেড়ে দিয়েছি। তবে মালিকপক্ষ নিয়োগ দেয়ার সময় জনপ্রতি ৪০-৫০ হাজার নেন। টাকা দিয়ে চাকরি দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় কাজটি বের করে আনতে মন্ত্রণালয় বা অন্য কোথায় কিছু (টাকা) খরচ হয়। এই টাকাটা তো মালিকপক্ষকে কোনো না কোনোভাবে তুলতে হবে।

জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিনুল ইসলাম সুলতানকে গত শুক্রবার (০৯ সেপ্টেম্বর) থেকে রবিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিট পর্যন্ত অসংখ্যবার তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

পরে এ বিষয়ে রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মো. ফারুক বলেন, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য আউট সোর্সিং-এর জনবল নিয়োগের মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য ইতোমধ্যেই আমরা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। যদি অনুমতি না দেয় তাহলে নতুন করে টেন্ডার করে নিতে হবে।

অর্থ লেনদেন কিংবা বেতন না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, টাকা দিয়ে জনবল নিয়োগ কিংবা বেতন পায়নি এমন কোনো অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেনি। অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের কার্যক্রম এখনো চলমান রয়েছে। যেহেতু এখনো এটির অনুমোদন হয়নি তাই ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বেতন-ভাতা বাকি রয়েছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাজশাহী,তানোর,আউট সোর্সিং,ঘুষ বিনিময়,বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close