আজহার মাহমুদ

  ১১ জুন, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

কোটাপ্রথা সংস্কার হওয়া প্রয়োজন

বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে চাকরিতে কোটা। কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনও হয়েছে কয়েক দফা। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। তবে, ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সরকার। গত ৫ জুন আবারও সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্য কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ফলে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল থাকবে। এটা নিয়ে ইতিমধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় চলছে বিতর্কের ঝড়। একই সঙ্গে গত ৫ জুন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি দিনে দিনে আরো খারাপের দিকেও যেতে পারে।

যদিও সংবিধানের আলোকে শুরু থেকেই বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ কোটা ছিল। সংবিধানের ২৯-এর ৩(ক) উপধারায় বলা আছে, ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূল বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবেনা।’ ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ওই সময় ৪০ শতাংশ জেলা কোটা, ১০ শতাংশ যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা এবং ২০ শতাংশ মেধা কোটা ছিল। এরপর ১৯৭৬ সালে জেলা কোটা ২০ শতাংশ কমিয়ে মেধা কোটা ৪০ শতাংশ করা হয়। ১৯৮৫ সালে মেধা কোটা ৪৫ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ এবং মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়। পরে ১৯৯৭ সালে এই কোটা ব্যবস্থাকে আরো সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে যোগ হয় ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। ফলে এর কোনো শ্রেণিতে যারা পড়েন না, তাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাকি ৪৪ শতাংশ পদের জন্য। এরপর আন্দোলনের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন পুরো কোটা প্রথাই বাতিল। যদিও সেটা নিয়েও ছিল বেশ বিতর্ক। মুক্তিযোদ্ধারা বেশ মর্মাহত হয়েছিলেন।

বেশ কয়েক বছর পর এবার আদালত আবারও কোটা প্রথা ফিরিয়ে আনার পক্ষে রায় দিয়েছেন। তবে সেটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কও চলছে বেশ। যদিও বিতর্কটা যৌক্তিক। এজন্য একটু হিসাব কষতে হবে। এই হিসাব বোঝার জন্য আপনার বিজ্ঞানী আইনস্টাইন হতে হবে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা হচ্ছে ১৬,৫১,৫৮,৬১৬ জন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ মুক্তিযোদ্ধা আছেন। যাদের কোটা ৩০ শতাংশ। প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ ১৬ হাজার, যাদের কোটা ১ শতাংশ। উপজাতির সংখ্যা ১৫ লাখ ৮৬ হাজার, যাদের ৫ শতাংশ কোটা। এ ছাড়া ১০ শতাংশ করে নারী ও জেলা কোটা রয়েছে। সব মিলিয়ে কোটা ৫৬ শতাংশ।

তাহলে দেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী, হিসেব দাঁড়ায় ৯৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ মানুষের জন্য সিট বরাদ্দ ৪৪ আর মাত্র ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষের জন্য ৫৬ শতাংশ সিট। এখানে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলার মতো আর কিছু নেই। স্পষ্ট দেখা যায়, এখানে বৈষম্যটা কতখানি প্রকট। অথচ এটার একটা অবসান হওয়া উচিত।

আমি চাই না কোনো কোটাই বাদ যাক। তবে যেসব কোটা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সেসব কোটা পরিমার্জন করা হোক। আমি কোটার বিপক্ষে নই। অনেকেই বলছেন কোটাপ্রথাটাই বাতিল করে দিতে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে এই কোটা রাখাটাও জরুরি। সেটা কত শতাংশ হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অনেকেই ১০ শতাংশ বলছে, আবার অনেকেই ১৫ শতাংশ বলছে। যার যার অভিমত সে প্রকাশ করছে। কিন্তু এভাবে ঢালাওভাবে মতামত দিয়েও আসলে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মুক্তিযোদ্ধাদের এই কোটা ২০ শতাংশে থাকলেই উপযুক্ত। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী কোটার সংখ্যা বাড়ানো উচিত। সেখানে মাত্র ১ শতাংশ, এটাও বেশ অযৌক্তিক।

তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, দেশের এই কোটা সমস্যার বিষয়টা দ্রুত সমাধান করে চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করুন। এভাবে চলতে থাকলে অনেক চাকরিপ্রার্থী হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়বেন। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক, সেই প্রত্যাশা রাখছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close