শাহ্ আহমাদ হোসাইন

  ১০ জুন, ২০২৪

করপরিকল্পনা

ফাঁকি না দিয়েও কর সাশ্রয়ের আইনি সুযোগ

আমরা অনেকেই মাথায় রাখি না যে, একটু পরিকল্পনা করে কিছু সহজ পদক্ষেপ নিলে আইনসংগত সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের আয়ের ওপর করের পরিমাণ বহুলাংশে কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি। যেহেতু আমরা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তে আছি, তাই কর রেয়াতের সুযোগ গ্রহণ করতে চাইলে সময় রয়েছে সামনে ৩০ জুন পর্যন্ত।

গত এক যুগের মধ্যে সাম্প্রতিককালে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির সামনে পড়েছে পুরো বিশ্ব। এর মধ্যে করোনা মহামারির চাপ সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায়, তখন নতুন সংকট ডেকে আনে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ। বাড়তে থাকে ডলার, জ্বালানি তেল ও খাদ্যশস্যের দাম এবং ব্যয় বেড়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের। সেই ধাক্কা সামাল দিতে দুই বছর ধরে ঘটেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এ ছাড়া দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বড় চাপে রয়েছে। যদিও সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেঅ এ ছাড়া জানুয়ারিতে গঠিত নতুন সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাকে অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কর কমাতে চায় সবাই। এ ক্ষেত্রে কিছু অসাধু করদাতারা কর ফাঁকি দেন। উল্লেখ্য, আয়কর আইন-২০২৩-এ কর ফাঁকি ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে আয়কর ফাঁকি দিলে বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তবে বৈধভাবেও কর কমানোর পথ রয়েছে। এ জন্য আপনাকে হতে হবে একটু কৌশলী এবং আপনার কাছে সঠিক তথ্য থাকতে হবে। সারা বছরের আয় থেকে একটু একটু সঞ্চয় করে অর্থবছরের শেষ দিকে নির্দিষ্ট জায়গায় বিনিয়োগ করুন। দেখবেন, আপনাকে কম কর দিতে হচ্ছে। করবছরে বিনিয়োগ করেই বৈধ উপায়ে আপনি কর কমাতে পারেন।

প্রতি বছর জুলাই থেকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত এই ১২ মাসের আয়ের ওপর কর বসে। এ সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু খাতে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়। কর রেয়াত বলতে কর কমানো বা কর কম দেওয়াকে বোঝায়। যেহেতু আমরা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তে আছি, তাই কর রেয়াতের সুযোগ গ্রহণ করতে চাইলে সময় রয়েছে সামনে ৩০ জুন পর্যন্ত।

আমরা অনেকেই মাথায় রাখি না যে, একটু পরিকল্পনা করে কিছু সহজ পদক্ষেপ নিলে আইনসংগত সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের আয়ের ওপর করের পরিমাণ বহুলাংশে কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি। যেহেতু কর সাশ্রয় করার জন্য কিছু বিশেষ খাতে বিনিয়োগ বা দান করতে হয়, তাই এ বিষয়ে জানা থাকলে তা একজন করদাতাকে তার উপার্জনের একটি বড় অংশ থেকে কর সাশ্রয় করে আয় বাড়াতে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে আপনাকে সঠিক পরিকল্পনা করে বিনিয়োগ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সঠিক ধারণা না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে বেশি আয়কর দিতে হচ্ছে।

নিয়ম অনুসারে, করছাড়ের সুবিধা পেতে একজন করদাতার বছরের পুরো আয়ের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারেন। এই সুবিধার আওতায় আপনার বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ পরিমাণ অর্থ করছাড় পাবেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, ধরি গত জুলাই থেকে জুন মাস পর্যন্ত আপনি ১০ লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। পুরোটাই আপনার করযোগ্য আয়। আপনি এই আয়ের ২০ শতাংশ বা ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন। ধরা যাক, আপনি সারা বছর একটু একটু খরচ বাঁচিয়ে দুই লাখ টাকাই বিনিয়োগ করলেন। তাহলে আপনি আপনার কর থেকে ৩০ হাজার টাকা (বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ হিসেবে) ছাড় পাবেন।

এবার যদি আপনি বিনিয়োগ না করতেন তাহলে কত কর হতো। বর্তমান নিয়মে, প্রথম সাড়ে ৩ লাখ টাকার জন্য কোনো কর নেই। অর্থাৎ, আপনার সাড়ে ৬ লাখ টাকার ওপর কর বসবে। সেই টাকার প্রথম ১ লাখের ওপর ৫ শতাংশ হারে কর ৫ হাজার টাকা। পরবর্তী ৪ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে প্রদেয় কর ৪০ হাজার টাকা। বাকি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ১৫ শতাংশ হারে সাড়ে ২২ হাজার ৫০০ টাকা। সর্বমোট করের পরিমাণ হতো ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা।

কিন্তু আপনি যেহেতু বিনিয়োগ করেছেন, তাই আপনি ৩০ হাজার টাকা ছাড় পাবেন। বিনিয়োগের কর রেয়াতের কারণে আপনার করের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। শুধু বিনিয়োগ করেই আপনি এতটা কর ছাড় পাচ্ছেন। এভাবে একজন করদাতা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় পেতে পারেন।

যেখানে বিনিয়োগ করে করদাতারা কর রেয়াত পাবেন, সেগুলো হলো প্রভিডেন্ট ফান্ডে (সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা)। এ ছাড়া কল্যাণ তহবিল ও গোষ্ঠী বিমা তহবিলে চাঁদা ও সুপার এনুয়েশন ফান্ডের চাঁদার ক্ষেত্রে। তা ছাড়া যদি কোনো জীবন বিমা করে থাকেন, তাহলে যে প্রিমিয়াম প্রতি বছর জমা দেন (বার্ষিক মোট বিমাকৃত অঙ্কের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ) তার ওপর কর রেয়াত পাবেন। পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোনো শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড অথবা ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পুরো অঙ্কই কর রেয়াতযোগ্য। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র ক্রয় এবং বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের ওপর নির্ধারিত হারে কর রেয়াত পাওয়া যায় (এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকার বিনিয়োগ কর রেয়াতযোগ্য)। যেকোনো তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপোজিট পেনশন স্কিমে বার্ষিক সর্বোচ্চ ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বিনিয়োগও কর রেয়াতযোগ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ৫টি বিনিয়োগ খাত হলো : প্রভিডেন্ট ফান্ড, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, জীবন বিমা, ডিপিএস ও ট্রেজারি বন্ড। এ ছাড়া যারা জাকাত দেন, তারা যদি সরকারের জাকাত ফান্ডে দান করেন, তাহলে সেই দানের বিপরীতেও কর রেয়াত পাবেন।

অবশ্যই মনে রাখবেন, আপনার এই বিনিয়োগগুলো অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই সম্পন্ন করতে হবে। যেমন : আপনি ২০২৪-২৫ করবছরের রিটার্নের কর রেয়াত নিতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই ২০২৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যেই বিনিয়োগযোগ্য খাতে বিনিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে। তবে করপরিকল্পনা মানে শুধুই করের পরিমাণ কমানো নয়। যথাযথ করপরিকল্পনা করলে করের পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি সবচেয়ে লাভজনক খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিনিয়োগের সর্বোত্তম ব্যবহার করা সম্ভব হয়, এ ছাড়া পরবর্তী সময়ে কর-সংক্রান্ত আইনগত জটিলতাও এড়ানো যায়।

করপরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে, সব আয়-ব্যয়ের হিসাব যথাযথ নিয়মে রেকর্ড রাখা এবং ট্যাক্সের সব নথি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা। যাদের অগ্রিম কর প্রদানের বাধ্যকতা রয়েছে, তাদের অগ্রিম কর যথাসময়ে জমা প্রদান করা এবং নির্ধারিত সময়ের ভেতর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়া।

করপরিকল্পনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা। করদাতার নিটসম্পদের পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার ওপরে থাকলে তাকে সারচার্জ দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো করদাতার একের অধিক গাড়ি থাকলে তাকে পরিবেশ সারচার্জ দিতে হবে। তাই সম্পদ ও গাড়ির মালিকানার ব্যাপারে আগে থেকে পরিকল্পনা করা থাকলে সারচার্জ থেকে ছাড় পেতে পারেন। এ ছাড়া উপহার ও ঋণের পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার বেশি হলে তা অবশ্যই ব্যাংকিং চ্যানেলে হতে হবে, নতুবা তা আয়করের আওতায় চলে আসবে।

আর্থসামাজিক বাস্তবতার কারণে আয়কর আইন প্রতি বছর পরিবর্তন হয়ে থাকে। এই আইন সম্পর্কে ধারণা থাকলে এবং প্রয়োজনে একজন পেশাদার আয়কর পরামর্শকের পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে করপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে পরে আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত থাকা যায় এবং নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রাখা যায়।

লেখক : চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (আইসিএইডব্লিউ)

আয়কর, ভ্যাট ও কোম্পানি আইন পরামর্শক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close