মনীষা রানী বিশ্বাস

  ০৮ জুন, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক

বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী একসূত্রে গাঁথা। একটি ছাড়া অন্যটি অচল। বিশ্ববিদ্যালয় হলো উচ্চশিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র, যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ে জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানবিকাশের প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই প্রক্রিয়ার গুণগত মান ও ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে কেমন সম্পর্ক বিরাজমান। বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানের উৎকর্ষের অন্যতম মাধ্যম, যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই উচ্চতর শিক্ষার বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে একত্র হন। শিক্ষকদের প্রধান চাওয়া হলো একটি সহায়ক ও সমৃদ্ধ পরিবেশ, যেখানে তারা নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা ও পাঠদান করতে পারেন। তারা চায় উন্নত পাঠ্যক্রম, পর্যাপ্ত গবেষণা তহবিল, এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উৎকৃষ্ট শিক্ষণ প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক যদি নতুন কোনো গবেষণা প্রকল্প শুরু করতে চান, তবে তার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা চায় এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যা তাদের জ্ঞান অর্জনকে সর্বোচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাদের চাহিদার মধ্যে রয়েছে যোগ্য শিক্ষকের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা, প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রী এবং একটি উপযুক্ত ও নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন। পাশাপাশি, তারা চায় তাদের পেশাগত উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ও সহযোগিতা। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষার্থী যদি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চায়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এই চাহিদাগুলো পূরণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত একটি সমন্বিত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যা তাদের উচ্চতর শিক্ষার মান উন্নয়ন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বাড়ি ছেড়ে এখানে পড়তে আসে। কাছে থাকে না তাদের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, কিংবা ছোটবেলার সেসব খেলার সাথিরাও। এখানে নতুন করে অচেনা পরিবেশে এসে খাপ খাওয়াতে অনেক সময় তাদের হিমশিম খেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সবচেয়ে আপনজন হলো শিক্ষকরাদ। যেকোনো সুখে-দুঃখে, বিপদে তারা সব সময়ই কামনা করে কোনো না কোনো শিক্ষক যদি তাদের পাশে থাকত, শুধু যদি বলত, ‘তুমি পারবে, আমরা তো আছি’ তাহলে বোধহয় ওই ছাত্র সত্যিই বিশ্বজয় করে দেখাতে পারে। শিক্ষকরাই আমাদের বাড়ির অভাবটুকু পূরণ করিয়ে দেন। একবার মাদার্স ডে- নিজের মাকে উইশ করার পর আমার একজন ফ্রেন্ড তার প্রিয় ম্যামকে মেসেজে বলছে, ‘You look a little bit like my mother, especially in the Department.’ এমন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কই তো সবাই চায় তাই না?

শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড এবং একজন ভালো শিক্ষক হলেন সেই মেরুদণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষার্থীরা যে ধরনের শিক্ষক চান, তা শুধু তাদের শিখন প্রক্রিয়াকে উন্নত করে না, বরং তাদের সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তা করে।

প্রথমত, শিক্ষার্থীরা এমন শিক্ষক চান যিনি জ্ঞানে পরিপূর্ণ এবং বিষয়বস্তুতে দক্ষ। একজন শিক্ষকের পক্ষে তার বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা আবশ্যক, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করে এবং তাদের শিখতে উৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন গণিত শিক্ষক যদি তার বিষয়ে দক্ষ হন, তবে তিনি শিক্ষার্থীদের জটিল গণিতের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম করবেন এবং তাদের মধ্যে গণিতের প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা এমন শিক্ষক চান যিনি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহানুভূতিশীল। শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যায় শিক্ষকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে, সে ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ তাদের মনে সাহস জোগায়। সহানুভূতিশীল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে পারেন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন সহানুভূতিশীল শিক্ষক যদি দেখে কোনো শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত কারণে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে, তবে তিনি তাকে মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা দিতে পারবেন।

তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীরা চান এমন শিক্ষক, যিনি শ্রেণিকক্ষে উদ্দীপনা ও আগ্রহ তৈরি করতে পারেন। শিক্ষণকে একঘেয়ে ও নীরস না করে রসিকতার মাধ্যমে বা বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে পাঠদান করলে শিক্ষার্থীরা সহজেই বিষয়টি বুঝতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন বিজ্ঞানশিক্ষক যদি বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ক্লাসের বিষয়বস্তু প্রদর্শন করেন, তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল ও আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

চতুর্থত, শিক্ষার্থীরা এমন শিক্ষক চান, যিনি যথেষ্ট ধৈর্যশীল এবং সমান মনোযোগ প্রদানকারী। প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিখন ক্ষমতা এক নয়; তাই একজন শিক্ষককে ধৈর্য ধরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বোঝানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষার্থী যদি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বারবার ভুল করে, তবে ধৈর্যশীল শিক্ষক তাকে ধীরে ধীরে বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন এবং তাকে আরো চেষ্টা করতে উৎসাহিত করবেন।

পঞ্চমত, শিক্ষার্থীরা চান এমন শিক্ষক, যিনি প্রেরণা দিতে পারেন এবং তাদের স্বপ্নপূরণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। একজন শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের পাঠই পড়াবেন না, তিনি শিক্ষার্থীদের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবেন এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রেরণা দেবেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন ভালো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তাদের স্বপ্নপূরণের পথপ্রদর্শক হতে পারেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে পারেন। শিক্ষার্থীরা চান এমন শিক্ষক, যিনি নৈতিক মূল্যবোধ এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ শেখাতে সক্ষম। একজন শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সহমর্মিতার মতো গুণাবলি গড়ে তোলা। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করেন, তবে তারা ভবিষ্যতে ভালো নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।

শিক্ষার্থীরা চান এমন শিক্ষক, যিনি জ্ঞানী, বন্ধুত্বপূর্ণ, উদ্দীপক, ধৈর্যশীল, প্রেরণাদায়ী এবং নৈতিক শিক্ষার ধারক। এ ধরনের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস এবং তাদের ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। এই গুণাবলিগুলো নিয়ে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন এবং তাদের জীবনে সফলতা এনে দিতে পারেন।

শিক্ষকরা ক্লাসে সাধারণত এমন শিক্ষার্থীদের পছন্দ করেন যারা মনোযোগী, আগ্রহী এবং শিখতে উৎসাহী। মনোযোগী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নির্দেশনা ও পাঠ্যবিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে, যা শিক্ষককে তার পাঠদান কার্যক্রম সহজ ও ফলপ্রসূ করতে সহায়তা করে। আগ্রহী শিক্ষার্থীরা সব সময় নতুন কিছু শিখতে চায় এবং ক্লাসের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন করে। এ ধরনের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে, যা শিক্ষককে আরো উৎসাহী করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞান ক্লাসে একজন শিক্ষার্থী যদি নতুন গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন করে, তবে শিক্ষকও নতুন তথ্য প্রদান করে আনন্দিত হন। শিক্ষকরা শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং দায়িত্বশীল শিক্ষার্থীদেরও পছন্দ করেন। এসব শিক্ষার্থী সময়মতো ক্লাসে উপস্থিত থাকে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয় এবং ক্লাসের নিয়মকানুন মেনে চলে। এর ফলে ক্লাসে একটি সুস্থ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবেশ বজায় থাকে।

অবশেষে, শিক্ষার্থীরা যদি সহযোগিতাপূর্ণ হয় এবং সহপাঠীদের সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকে, তবে শিক্ষকরা তাদের বিশেষভাবে পছন্দ করেন। এটি একটি সমবায়ী শিখন পরিবেশ তৈরি করে।

১. সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক : শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত পারস্পরিক সম্মান। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন এবং শিক্ষার্থীরাও তাদের শিক্ষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে শ্রদ্ধা করবে।

২. সহযোগিতা এবং সমর্থন : একটি কার্যকর শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমর্থন অত্যন্ত জরুরি।

৩. যোগাযোগের প্রাসঙ্গিকতা : শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে খোলামেলা এবং কার্যকর যোগাযোগ একটি সুস্থ সম্পর্কের অন্যতম প্রধান উপাদান। শিক্ষার্থীরা যদি কোনো বিষয়ে অসুবিধায় থাকে, তবে তাদের উচিত তা শিক্ষকের সঙ্গে শেয়ার করা এবং শিক্ষকের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া।

৪. শিক্ষকের নেতৃত্ব ও শিক্ষার্থীর উদ্দীপনা : শিক্ষককে শুধু পাঠদানকারী হিসেবে না দেখে একজন নেতা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, যিনি শিক্ষার্থীদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন। শিক্ষার্থীরা যদি তাদের শিক্ষকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তারা তার নির্দেশনা মেনে চলতে অনুপ্রাণিত হবে।

৫. উদ্দীপনা এবং আগ্রহ সৃষ্টি : শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্দীপনা এবং আগ্রহ সৃষ্টি করা। বিভিন্ন শিক্ষণ কৌশল ও পদ্ধতির মাধ্যমে ক্লাসকে আকর্ষণীয় ও গতিশীল করে তোলা সম্ভব।

৬. সহানুভূতি ও সমর্থন : শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সহানুভূতি। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের সহানুভূতিশীল ও সহায়ক ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।

শিক্ষক শিক্ষকই। দেশ ও জাতির বিবেক, কর্ণধার ও পথপ্রদর্শক। ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার’- কবির এই বাক্য চিরকালের সত্য। এই শ্রেষ্ঠত্বের আসনকে যারা হেয় করতে চায়, তারা আসলে বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close