সোলায়মান মোহাম্মদ

  ২৩ মে, ২০২৪

মুক্তমত

শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশে মেধাবীদের অনীহা

পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক নেবে প্রায় লাখখানেক কিন্তু আবেদন করেছে মাত্র ৩০ হাজারের কিছু বেশি। আর তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছিল ৯৯ লাখের ওপরে। আমি তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। আমাদের সময় ১ কোটি আবেদন থেকে নিয়েছে মাত্র ৩৪ হাজারের মতো। তবুও সেখানে ৮-১০ হাজার নিয়েছিল আমার মতো ফ্রেশ, বাকিরা ইনডেক্সধারী (আগেই নিয়োগপ্রাপ্ত যারা বদলির জন্য আবেদন করেছিলেন)। অর্থাৎ আমাকে চাকরিটা নিতে হয়েছিল প্রায় ১০০০/১২০০ ইনডেক্সধারী এবং নন-ইনডেক্সধারী মেধাবীদের বিপরীতে।

ভাবা যায়? মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে শিক্ষকতা পেশাকে মেধাবীরা কতটা এড়িয়ে গেল? এটা কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা না যোগ্যতা নাকি অন্য কিছু। শিক্ষক নেবে ৯০ হাজারের ওপরে আর আবেদন করেছে ৩০ হাজার। বোঝা গেল কিছু?

পৃথবীর সব পেশাতেই বদলির ব্যবস্থা আছে। শুধু বেসরকারি শিক্ষকদের নেই। নেই বলতে শিক্ষাব্যবস্থায় ঘাপটি মেরে থাকা কিছু কুচক্রী মহল, যারা চায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হোক, আলটিমেটলি দেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হোক। ৭১-এ যারা পাকিস্তানিদের দালাল ছিল, যাদের আমাদের বীর সন্তানরা হারিয়েছে। তবে তাদের কিছু প্রেতাত্মা এখনো রয়ে গেছে। তাদের কেউ কেউ শিক্ষা অধিদপ্তরের কিছু চেয়ার দখলে নিয়েছে। যারা এ দেশকে ব্যর্থ করতে চায়। যেহেতু শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করতে পারলেই, জাতি চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হবে সুতরাং তারা তাই করছে। শিক্ষকদের বদলি আটকে শিক্ষকদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। ফলে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে শ্রেণি পাঠদানে। ফলে শিক্ষার্থীরা তেমন কিছুই শিখতে পারছে না। তা ছাড়া একজন শিক্ষক, অসুস্থ মা-বাবা, কলিজার টুকরো সন্তান, প্রিয় স্ত্রী এবং নিজের সমাজ শতশত মাইল দূরে রেখে অল্প বেতনে কখনোই থাকাণ্ডখাওয়া এবং পাঠদানে মনোনিবেশ করতে পারে না, পারবে না। কোনো মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। আর এ সুযোগটাই নিচ্ছে ওই প্রেতাত্মারা। নানা অজুহাতে নানা কৌশলে তারা বদলি কার্যক্রম বন্ধ রাখছে, যা লাখো শিক্ষক এবং শিক্ষক পরিবারের প্রাণের দাবি। যে বদলি ব্যবস্থা চালু হলে সরকারের অতিরিক্ত কোনো টাকায় ব্যয় হবে না। যেহেতু সমপদে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে বদলি হতে পারে। আলাদা গণবিজ্ঞপ্তি কিংবা কয়েকটি প্রক্রিয়াতেই বদলি সম্ভব। বদলি বন্ধের যে কারণ বলা হচ্ছে, তা সত্যিই হাস্যকর। তারা বলছে, বদলি চালু করলে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকশূন্য হয়ে যাবে। এগুলো পাগলের

প্রলাপ ছাড়া কিছুই না। যেখানে নিয়োগের পর বদলির ক্ষেত্রে দুবছর চাকরি করার শর্ত থাকতে পারে। তা ছাড়া প্রতি বছর তো নিয়োগ হচ্ছেই। সেখানে কী করে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকশূন্য হবে? যেখানে দূরে চাকরিরত সব শিক্ষকই নিজ নিজ উপজেলায় যেতে মুখিয়ে আছেন।

খুব কষ্টের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, মেধাবীরা আজ শিক্ষকতা নামক মহান পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। মাত্র দুবছরের ব্যবধানে আবেদনের এই বেহাল অবস্থা। যেখানে লাখো শিক্ষিত বেকার আমাদের সোনার বাংলায়। চাকরির অভাবে উপায়ন্তর না দেখে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথও অনেকেই বেছে নেয়। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি, যেখানে চাকরির বাজার এত খারাপ, সেখানে শিক্ষকতায় প্রবেশে কাঙ্ক্ষিত চাহিদার দ্বারের কাছেও আবেদন জমা পড়ছে না।

এনটিআরসিএ, মাউসি, মাদরাসা অধিপ্তর তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এখন আর আমাদের আশার কিছুই নেই। এসব জায়গায় যে কজন ভালো কর্মকর্তা রয়েছেন, সিন্ডিকেট তথা ওই প্রেতাত্মাদের কূটকৌশলের কাছে তারা ধরাশায়ী। যখন-তখন হুটহাট নোটিস জারি এবং তা প্রত্যাখ্যান করতেও বিবেচনায় রাখা হয় না। স্কুল-কলেজ বন্ধ এবং খোলা রাখার বিষয়টিই দেখেন না। কী হুটহাট সিদ্ধান্ত প্রকাশ এবং কিছুক্ষণ পরই তার পরিবর্তন। এ যেন একচেটিয়া রামরাজত্ব।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যতগুলো সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সবগুলোই দুর্নীতিতে ভরা। দেখার কেউ নেই। দুদক বা সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো মহল এখানে তদন্ত করলে দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। বেতন, পদ ও অন্য সবকিছুতেই বৈষম্য এবং দুর্নীতির শেষ স্টেজ পার করেছে এরা। জাল সনদে হাজার হাজার শিক্ষক চাকরি করছে, যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশও হয়েছে কিন্তু কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। অনেক শিক্ষকের দাবি এনটিআরসিএর বেশ কিছু কর্মকর্তারা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের শেষ পেড়েকটাও মেরে দিছে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের গাড়ির ড্রাইভাররাও কোটি কোটি টাকার মালিক। প্রতিটি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ১০ বছর বা একটি সুনির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর মিনিস্ট্রি অডিট হয়। যারা মিনিস্ট্রি অডিটে আসেন তারা শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের কাগজীয় শত সমস্যা থাকার পরও মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে অডিট পেপারস পজিটিভলি সাবমিট করেন। বলা যায়, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, যা দিন-রাত বলেও শেষ করা যাবে না।

কাজেই দেশরত্ন, প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা অধিদপ্তরের দিকে সুবিশেষ নজর এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ না করলে শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

হারিকেন দিয়েও মেধাবী শিক্ষক খোঁজে পাওয়া যাবে না। জাতীয়করণসহ

শিক্ষকদের সব সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবার শেষ সময় চলছে। এখন হয়তো শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশেই অনীহা, কেউ আবেদনই করতে চাচ্ছেন না। উপরন্তু যারা দূর-দূরান্তে শিক্ষকতা করছেন, তারা একদিকে চাকরি নামক সোনার হরিণ এবং অন্যদিকে মহান পেশা এই শিক্ষকতা থেকে ইস্তফা দেবেন। তখন হয়তো আগামীর প্রজন্ম চারদিকে অন্ধকারাচ্ছন্নই দেখবে।

লেখক : শিক্ষক এবং কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close