বিপ্লব বড়ুয়া

  ২২ মে, ২০২৪

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা

অস্তিত্বের সংকটে সমতলীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়

মহামানব গৌতমবুদ্ধ আজ থেকে আড়াই হাজারের বছর পূর্বে যে শান্তি ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছিলেন একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এই বিশ্বজগতে, এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটছে। বিশ্বব্যাপী তা এখন অন্যতম গবেষণার বিষয়। তৎসময়ে ভগবান তথাগত গৌতম বুদ্ধ হিংসা, শত্রু, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, সহনশীলতা, বৈরিতা, সুখ, দুঃখ, ভোগ, বিলাস থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নিজে জয় করে মানবমুক্তির উদ্দেশ্যে মৈত্রী, শান্তি, সম্প্রীতির বাণী প্রচার করে মানুষের জীবনমানে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। আজ তার বাণী ও দর্শন বিশ্বের জ্ঞান-ভাণ্ডারকে আলোকিত করেছেন। তিনি কোনো ধর্মপ্রচারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবিক দর্শনের পুরোধা প্রবক্তা। যেটি নিজে আত্মস্থের মধ্য দিয়ে মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত দুঃখ-নিপীড়িত জর্জরিত জীবন থেকে মুক্তির পথে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি রক্ত-মাংসের শরীরে গড়া মায়ের গর্বে জন্ম নেওয়া একজন অদ্ধিতীয় দৃশ্যমান ব্যক্তি মানবতার জয়গান গেয়ে মানুষের মনের গহিনে ঠাঁই করে নিয়েছেন। তিনি অলৌকিকতা বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন। শোনা কথায় কান দিতে নিষেধ করেছেন। যাচাই-বাচাই করে ভালো লাগলে গ্রহণের কথা বলেছেন, খাড়াপ লাগলে ত্যাগ করার কথা বলে গেছেন।

ভগবান বুদ্ধ বলেছেন বলে গ্রহণ করতে হবে, তারও সতর্কবাণী দিয়েছেন। প্রাণী হত্যা, মিথ্যা কথা, চুরি, ব্যভিচার, লোভ, স্বার্থপরতা, অন্যের ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকার কথা যেমন তিনি বলেছেন, তেমনি বলেছেন, শত্রুকে মৈত্রী দিয়ে জয় করার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি- বিশ্বব্যাপী এখন ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা, নিরস্ত্র মানুষের সবলের প্রাণসংহার, ধর্মের নামে মিথ্যার বসবাস। উগ্রবাদীদের প্রবল উন্মাদনায় সময়ে সময়ে বৌদ্ধ সংস্কৃতি হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত। অন্য ধর্মের মতবাদীদের দোষ দিই কেন! যেখানে এখন খোদ নিজ সম্প্রদায়েরর গুটিকয়েক ছদ্মনামধারী ধর্মগুরু যখন ধর্মের নামে নোংরা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা গুজব রটিয়ে পুরো দেশ ও সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি খুন্ন করে। এই ধর্মগুরুরা কোন আদর্শ বাস্তবায়ন করার পথে নেমেছের, সাধারণ ধর্মপ্রাণ নর-নারীর বোধগম্য নয়! যেখানে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে দেশকে বিশ্বের সামনে উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত করছে, সেই মুহূর্তে উগ্রবাদী ধর্মগুরুদের এমন আস্ফালন দেশ ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র!

মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতমবুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের দেবদেহ নগরের সীমান্ত অঞ্চলের লুম্বিনী কাননের উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন কপিলাবস্তু নগরীর রাজা শুদ্ধোধন। মায়ের নাম ছিল রাণী মহামায়া। সিদ্ধার্থের জন্মের সাত দিন পর মা মহামায়া ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর কুমার সিদ্ধার্থকে কোলেপিঠে লালনপালন করে আপন সন্তানের মায়ায় বড় করে তুলেন সৎ মা মহাপ্রজাপতি গৌতমী। গৌতমী এমন স্নেহ-আদরে মানুষ করেন এই কথা সন্তান সিদ্ধার্থকে কখনো বোঝার সুযোগ দেয়নি। সংসারের প্রতি ছিল উদাসীন। কুমার সিদ্ধার্থকে সংসার অনুরাগী করার জন্য ১৬ বছর বয়সে যশোধরা নামের সুন্দরী এক রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধার্থ-যশোধরা দম্পতির কোল আলো করে একটি সন্তান প্রসব হয়। ছেলের নাম রাখলেন রাহুল।

এদিকে সংসারচক্রে উদাসীন ছেলে সিদ্ধার্থকে খুশি রাখতে পিতা রাজা শুদ্ধোধন চার ঋতুর জন্য চারটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। যেখানে পুত্রের মনোজগৎ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সব রকম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন তার পিতা। এক দিন কুমার সিদ্ধার্থ রথে চড়ে নগর পরিভ্রমণের জন্য বের হন। ছেলের এমন মনোযোগে পিতা রাজা শুদ্ধোধন সারা কপিলাবস্তু নগরীতে সাধারণ মানুষদের উৎসব করার নির্দেশ প্রদান করেন। বেশ কয়েক দিন ভ্রমণে বের হয়ে কিছু প্রশ্ন তাকে পেয়ে বসে। যে বিষয়গুলো রাজ সন্তানের জন্য কাঙ্ক্ষিত ছিল না। প্রথম দিন পরিভ্রমণে বের হয়ে দেখেন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাফেরা করছেন। দ্বিতীয় দিন একজন অসুস্থ মানুষ রাস্তার ধারে পড়ে কাঁতরাচ্ছেন। তৃতীয় দিন কিছু মানুষ এক মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তার দৃষ্টি গোচরীভূত হয়। চতুর্থ দিন একজন সন্ন্যাসীকে হেঁটে যেতে দেখে তিনি তার সঙ্গে থাকা সারথিকে প্রশ্ন করেন। হে সারথি এই চার দিন একে একে আমি রক্তমাংস গড়া মানুষদের যে অবস্থায় দেখলাম, তাদের জীবনটা এ রকম হলো কেন?

সারথি সিদ্ধার্থকে বললেন, ‘হে রাজপুত্র-জগৎ দুঃখময়’। আরো বললেন, সংসারের মায়া-মমতা, রাজ্য, ধন-সম্পদ কোনো কিছুই চিরকাল স্থায়ী নয়। এই সুন্দর অবিনশ্বর পৃথিবী থেকে সবকিছু এক দিন মুছে যাবে। আপনজন বলতে কোনো কিছুই থাকবে না। এভাবে কুমার সিদ্ধার্থ দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে ২৯ বছর বয়সে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে পরিবারের সবার অগোচরে গৃহত্যাগ করে চলে যান। পাহাড়-পর্বত, বনে-জঙ্গলে নীরব কোলোহলমুক্ত পরিবেশে দীর্ঘ ৬ বছর কঠোর সাধনার পর ভারতের বিহার প্রদেশের বুদ্ধগয়া নামক স্থানে ৫৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৩৫ বছর বয়সে বোধি বৃক্ষের নিচে বোধিজ্ঞান লাভ করে সম্যকসম্বুদ্ধপ্রাপ্ত হন। এরপর তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ ৪৫ বছর তার অর্জিতজ্ঞান মানুষের কল্যাণে প্রচার করেছিলেন। তার এই বাণী ও দর্শন পরবর্তীকালে নামানুসের একটি সর্বজনীন মনস্কতাপূর্ণ ধর্মে পরিণত হয়। ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামানব তথাগত বুদ্ধ আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে কুশিনগর নামক স্থানে শালবৃক্ষের নিচে ৮০ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। পৃথিবী জুড়ে এই মহামানবের বাণী আজো সর্বজনীনভাবে সমাদৃত।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close