কাজী সাতিল মোহাম্মদ আকিব

  ২২ মে, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

পশ্চিমা দ্বিচারিতা বনাম মানবাধিকার

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমারা সারা বিশ্বকে বয়ান দিলেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাদের মুখোশ খসে পড়ে স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। পশ্চিমাদের চোখে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র যে একেক দেশে একেক রকম তা আজ স্পষ্টত দৃশ্যমান। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলিদের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পশ্চিমা পক্ষপাতদুষ্ট নেতাদের চোখে অশ্রু নামলেও এখন পর্যন্ত গাজার ভয়াবহ চিত্র দেখে কথিত মানবতাবাদীদের মনে দাগ কাটেনি।

গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৫ হাজার ছাড়িয়েছে। যার অধিকাংশ নারী ও শিশু। দখলদার ইসরায়েলের আগ্রাসন থেকে নিষ্পাপ শিশু, নিরস্ত্র নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, হাসপাতাল, রোগী কেউই রেহাই পাচ্ছে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।

সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসির হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে হলোকাস্টের বার্ষিক স্মরণানুষ্ঠানে বাইডেন বলেন, ‘হামাসই ইসরায়েলিদের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছে। হামাসই ধরে নিয়ে গিয়ে লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছে। আমি ভুলে যাইনি।’ বাইডেনের এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তারা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বকে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে হিসাব করতে চান। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট যে ফিলিস্তিনিদের ওপর দীর্ঘদিনের নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, গুম, দখলদারিত্বের। তারা এ বিষয়টি সব সময় এড়িয়েই যেতে চেয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অসন্তোষকে সামনে আনতে চান না। কেননা এতে তাদের দ্বিচারিতা প্রকাশ পেয়ে যাবে।

হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, গাজার গণহত্যা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সমালোচনা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা বললেও, অন্যদিকে বিশ্ব জনমত ও নিজ দেশের অধিকাংশ নাগরিকদের মতামতকে পাশ কাটিয়ে জাতিসংঘে উত্থাপিত যেকোনো ধরনের ইসরায়েল স্বার্থবিরোধী প্রস্তাবে ভেটো দেয়। যেমন : গত ১৮ এপ্রিল জাতিসংঘে রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার পথ ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যে রাফায় বড় ধরনের স্থল অভিযান চালানোর আশঙ্কা থেকেই ইসরায়েলে ১ কোটি ৮০ লাখ ২ হাজার পাউন্ড (৯০৭ কেজি) ও ১৭ লাখ ৫০০ পাউন্ড ওজনের বোমার চালান স্থগিত করলেও একই সঙ্গে রাফায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষে সাফাই গাইছে বাইডেন।

একদিকে ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধে চাপের নাটক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একাংশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বললেও অন্যদিকে নিজ দেশের জনগণ ও বিশ্ব জনমতকে পাশ কাটিয়ে ইসরায়েলের জন্য ২৬ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা বিল পাস করেছে। অর্থাৎ একদিকে ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষা, অন্যদিকে লোকদেখানো কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার নাটক করে দুদিকেই ভারসাম্য বজায় রাখার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছেন।

গত এপ্রিলে প্রকাশিত ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির ভাষ্য মতে, দুই বছরের অধিক সময়ের যুদ্ধে ৩১০০০ ইউক্রেনীয় সৈন্যের বিপরীতে ৫০০০০ রাশিয়ান সৈন্য হারিয়েও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পুতিনের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিলেও ইসরায়েলি অভিযান শুরুর মাত্র ৭ মাসেই গাজার ৩৪ হাজারের অধিক মানুষ হত্যাকারী নেতানিয়াহু ও তার দখলদার সৈন্যের বিরুদ্ধে সেই একই আদালতের তদন্তের ঘোর বিরোধিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ২৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন রিপাবলিকান সিনেটর আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটরকে পাঠানো চিঠিতে নেতানিয়াহু ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তিনিসহ তার পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিষিদ্ধ করার হুমকি দিয়েছে, যা মানবতার জন্য দুঃখজনক!

ফিলিস্তিন সমস্যা এভাবেই তাদের দ্বিমুখিতাকে জনসম্মুখে বের করে দিচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা প্রক্সি যুদ্ধ চালালেও ফিলিস্তিনে কি যুদ্ধ হচ্ছে? ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে তাকে স্রেফ গণহত্যা ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। আর সেই গণহত্যায় বিশ্ব জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্লজ্জ সমর্থন ও অর্থায়ন করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা।

ইউক্রেনে রাশিয়ান হামলা ও ইসরায়েলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর পশ্চিমা নেতারা কয়েকবার সে দেশগুলোতে সফর করলেও ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত সীমানার ওপারের গাজায় একবারও যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এ হামলায় নিহত ১২০০ ইসরায়েলির জন্য পশ্চিমারা ‘হামাস’কে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষণা দিলেও গত ৭ মাসে ৩৪ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি হত্যাকারী ইসরায়েলকে ‘আত্মরক্ষাকারী’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বুঝিয়েছে যে মানবতা বিসর্জন দিয়ে হলেও মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবে।

অনেক দেশে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের কথা বলে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করলেও ইসরায়েল কর্তৃক আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহসহ অনেক সাংবাদিককে পরিবারসহ হত্যা এবং ইসরায়েলে আল-জাজিরার সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ তো দূরের কথা, কোনো শক্তিশালী বিবৃতি পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালানোর ফলে আত্মরক্ষার অজুহাতে গাজায় নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সমর্থন জোগানো সেই ইসরায়েলই যখন ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলা চালিয়ে ইরানের কূটনীতিকদের হত্যা করে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে, তখন এর বিরুদ্ধে টু শব্দ পর্যন্ত না করলেও ইরানের পালটা হামলায় তারা একযোগে প্রতিবাদ জানানোয় প্রশ্ন উঠে আত্মরক্ষার অধিকার কি শুধুই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রের?

পশ্চিমারা নিজেদের গণতন্ত্রের সপক্ষের শক্তি পরিচয়ে উত্তর কোরিয়া, ইরান, রাশিয়া, চীনে গণতন্ত্র চাইলেও সৌদি আরব, মিসর, জর্ডানের মতো আরব দেশগুলোতে স্বৈরতন্ত্রের রক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। এমনকি মিসরে মুরসি, পাকিস্তানে ইমরান খানসহ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অনেক সরকারকে উৎখাত করেছে গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিরা। এই হচ্ছে তাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চিত্র।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তারা অন্য দেশে কেন গণতন্ত্রের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চায়? সারা বিশ্বে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতার কথা বলা সেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্তত এক ডজন দেশে বর্তমানে গণহত্যাবিরোধী বিক্ষোভ চলমান। আর সেখানে গত ৭ মে ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন করে বিক্ষোভরত প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের তাঁবু গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। অনেক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার এবং ডিগ্রি না দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৬০০-এর অধিক শিক্ষার্থী ও ৪০ জন অধ্যাপক। পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে হার্ভার্ড ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টকে। এ হচ্ছে গণতন্ত্রের ধারক বাহকদের অগণতান্ত্রিক রূপ।

স্বয়ং ইসরায়েলের ঘরে-বাইরে ইহুদিরা ও যখন স্বাধীন ফিলিস্তিন ও গণহত্যার বিপক্ষে প্রতিবাদ করেছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মান, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে গাজার গণহত্যায় ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরোধিতাকে ঈশ্বর বিরোধিতার মতো রূপ দিয়ে বিক্ষোভ দমনের ঘৃণ্য পদক্ষেপ বেছে নিয়েছে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরোধিতা মানেই ইহুদিবিদ্বেষ, ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় এ-সংক্রান্ত একটি বিতর্কিত বিল পাস করেছে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ। এটি আইনে পরিণত হলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল। এদিকে জার্মান সরকার হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইসরায়েলকে ন্যায়-অন্যায় সবদিকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করবেন। কিন্তু তারা যে এক গণহত্যার দায় শোধ করতে গিয়ে আরেক গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে জগন্য রকম অপরাধ করছে তা কি আদৌ ভাবছে তারা?

১২ এপ্রিল বার্লিনে আয়োজিত সম্মেলন পুলিশ কর্তৃক পণ্ড করার পর সম্মেলনের তিন মূল বক্তা ইয়ানিস ভারোফাকিস, ঘাসান আবু-সিত্তা এবং সালমান আবু-সিত্তার বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ওপর অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যে জার্মানিতে ফিলিস্তিন সম্পর্কে কথা বলতে পারবেন না। এমনকি জুমকলের মাধ্যমেও না। এ ঘটনাটি এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে, আজকাল জার্মানিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং গাজায় তাদের আচরণের যেকোনো সমালোচনাকে ইহুদি-বিদ্বেষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডানপন্থি অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) দলের ইসরায়েলপন্থি রাজনীতিবিদরা (এর মধ্যে নাৎসি স্লোগান ব্যবহার করার জন্য বিচারাধীনরাও আছেন) ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে ‘ইহুদি-বিদ্বেষ’ মোকাবিলার নামে ইচ্ছামতো কথা বলতে পারবেন। কিন্তু ফিলিস্তিনি সার্জন এবং যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ঘাসান আবু-সিত্তাহ জার্মান জনসাধারণকে তার অভিজ্ঞতা জানাতে পারবেন না।

সর্বোপরি বলা যায়, পশ্চিমা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের যত সংজ্ঞায়ন তা শুধু স্বার্থের নিরিখে নির্ধারিত হয়। বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বললেও যে তাদের উদ্দেশ্য স্বার্থ উদ্ধার তা বলার বাকি রাখে না। ফিলিস্তিনে ভয়াবহতা দিন যত যাচ্ছে ততই পশ্চিমা স্বার্থের মানবতার মুখোশ খসে পড়েছে। নতুন প্রজন্ম তাদের এই দ্বিমুখী আচরণের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হচ্ছে। ফলে নতুন প্রজন্মের সামনে পশ্চিমা মানবতা বনাম বাস্তবতা আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close