রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২২ মে, ২০২৪

আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ

নতুন দিগন্ত উন্মোচনে ইরাক-তুরস্কের যাত্রা

দীর্ঘ ১১ বছর পর ২২ এপ্রিল ইরাক সফর করলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তার এই সফরে মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই দেশের সম্পর্ক মেরামত ও কুর্দিদের দমনে সহায়তা, জ্বালানি ও বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কয়েকটি চুক্তি হওয়ার কথা। যদিও বিভিন্ন ইস্যুতে কয়েক বছর ধরে তুরস্ক ও ইরাকের মধ্যে টানাপড়েন চলছে। বিশেষ করে কুর্দিদের দমনে তুর্কি বাহিনী যেভাবে ইরাকের ভেতরে হামলা করে আসছে তা ভালোভাবে নেয়নি বাগদাদ। ইরাকের দাবি, এসব হামলার কারণে দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হচ্ছে। যদিও তুরস্ক বলছে, কুর্দি পিকেকের হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষায় এসব অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের বসন্তে কুর্দিদের বিরুদ্ধে একটি নতুন অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে তুরস্ক। আর এ অভিযানে ইরাকের সামরিক সহায়তা চেয়েছে দেশটি। একই সঙ্গে পিকেকে যে তুরস্কের জন্য হুমকিস্বরূপ বাগদাদের কাছে বিষয়টির স্বীকৃতি দাবি করেছে আঙ্কারা। এ ছাড়া এবারের আলোচনায় বিভিন্ন বড় বড় অর্থনৈতিক প্রকল্পও রয়েছে। ইরাকি ও তুর্কি কর্মকর্তারা বলছেন, এরদোয়ানের এই এক দিনের সফরে দুই দেশের মধ্যে ২০টির বেশি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানির পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ফরহাদ আলাদিন বলেছেন, এই সফরের জন্য দুপক্ষ প্রায় এক বছর ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এই সময় দুই দেশের মাঝে আগে সংকট তৈরি করেছে, এমন সব বিষয় দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের চতুর্থ বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হলো কুর্দিরা। বর্তমানে তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, ইরান ও আর্মেনিয়ায় বসবাস করছেন তারা। এত বড় জাতি হলেও তাদের আলাদা কোনো রাষ্ট্র নেই।

তাই তুরস্কের ভেতরে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে ১৯৮৪ সালে অস্ত্র তুলে নেয় কুর্দিরা। তারপর থেকে কুর্দিদের দমনে তুরস্কের সিরিজ অভিযানে ৪০ লাখের মতো মানুষ মারা গেছেন। এত দিন দুপক্ষের মধ্যে এই সংঘাত দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের গ্রাম এলাকায় সংগঠিত হলেও এখন তা ইরাকের কুর্দিস্তানের পাহাড়ি এলাকায় সংগঠিত হচ্ছে। সুতরাং এরদোয়ানের এই ঐতিহাসিক সফর থেকে মনে হচ্ছে, তুরস্ক তার পররাষ্ট্র নীতিতে নতুন একটি ধারণা যুক্ত করেছে। সেই ধারণা অনুযায়ী আঙ্কারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর দিকে হাঁটছে। তবে এই ধারণার দুটি স্তম্ভ রয়েছে। একটি হলো অর্থনীতিভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি; অন্যটি হলো আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা। আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে নানা দিক থেকে পারস্পরিকনির্ভরতা সৃষ্টি করে তুরস্ক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে তার আঞ্চলিক নীতি পরিচালনার জন্য একটি রূপরেখা নিয়ে এগোচ্ছে। হয়তো সে কারণেই ইরাকের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর আগেই এরদোয়ান মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দরজায় কড়া নেড়েছেন। আসলে মধ্যপ্রাচ্য এখন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে এবং সেখানে একটি নতুন ইতিবাচক প্রবাহের প্রয়োজন। সিরিয়া যুদ্ধে একের পর এক মোড় পরিবর্তন, লিবিয়া ও পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকায় তুরস্কের উপস্থিতি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সবগুলোই তুরস্ককে তার পররাষ্ট্রনীতিতে সংকট ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য করেছে। এই সংকটগুলোর এখনো মীমাংসা হয়নি; তবে এগুলো মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় আছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং ইরান-ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিভুজ বিরোধ নিষ্পন্ন করার ক্ষেত্রে তুরস্ক তার প্রভাবকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে পেরেছে।

এ ছাড়া নাগোর্নো-কারাবাখ সংঘাতের সময় আজার-বাইজানের পক্ষ নিয়ে তুরস্ক যে সুবিধা পেয়েছিল, সেটি আঞ্চলিক স্তরে আঙ্কারার হাতকে শক্তিশালী করেছে। এখনো তুরস্ক ও ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত আছে এবং এই দুই শক্তির রশি টানাটানির মূল জায়গার একটি হলো ইরাক, আরেকটি হলো সিরিয়া। এসব কারণে আঞ্চলিক ইস্যুতে আলোচনা করতে তুরস্ক অনেক আগে থেকে ইরান, সিরিয়া এবং রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে আসছে এবং এখন সে ইরাকের দিকে ঝুঁকছে। ইরাকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর থেকে সেখানে ইরানি প্রভাবের প্রতি জনগণের বিতৃষ্ণার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সেখানকার জনগণ ইরানের প্রভাবকে আর ভালোভাবে নিচ্ছে না। ২০২০ সালে বাগদাদে ইরানি কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি মার্কিন হামলায় নিহত হওয়ার পর থেকে ইরাকে ইরানের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার পরও শুধু ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে আঙ্কারা এই অঞ্চলের ইস্যুগুলো থেকে তেহরানকে বাদ দিতে চাইছে না। বরং তুরস্ক চায় ইরান এই অঞ্চলে তার ভূমিকা ধরে রাখুক, তবে নিয়ন্ত্রিত পরিসরে। তুরস্ক মনে করে, ইরানকে আঞ্চলিক ইস্যুগুলো থেকে যত সরিয়ে দেওয়া হবে, তেহরান তত বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। সে ধরনের পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। ইরাকের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব একটি অর্থনৈতিক ও সেবাভিত্তিক সরকারি কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে কিছুটা শক্তিশালী হতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী সুদানি যখন তার সরকারি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তখন সেই তালিকায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

সুদানির নেতৃত্বাধীন ইরাক এখন রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে বেশি কথা বলছে। এটিকে ইরাকি জনগণ ও রাজনীতিবিদরা ব্যাপকভাবে স্বাগত জানাচ্ছেন। বিশেষ করে ২০২১ সালের নির্বাচনের পর থেকে প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে ইরাক সরকারের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টাকে তারা ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। ঐতিহাসিকভাবেই ইরানের মধ্যপ্রাচ্য নীতি পরিচালনার মূল ঘাঁটি হলো ইরাক এবং তেহরান সেই ঘাঁটিকে কোনো অবস্থায় পুরোপুরি হাতছাড়া করতে চায় না। তবে সেখানে ইরানের অবস্থান এখন বেশ নড়বড়ে হয়েছে। যেমন : আমরা আগে ইরাকে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডারদের যেভাবে দেখতাম, এখন সেভাবে দেখতে পাই না। উপরন্তু ইরাকি মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো ইরাকের অভ্যন্তরের চেয়ে ইরাকের বাইরে বেশি তৎপরতা চালাতে পছন্দ করছে বলে মনে হচ্ছে। এতে বোঝা যায়, ইরান ইরাকে তার তৎপরতা কমিয়ে দিচ্ছে। এটি তুরস্ককে ইরাকের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে চমৎকার একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। কারণ, তুরস্ক ইরাক ইস্যুতে ইরানকে সম্পূর্ণরূপে বাদ না দিয়ে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থা বজায় রেখে কাজ করতে পারছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তুরস্ক সেই ধরনের কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। তুরস্কের এই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হতে পারে ইরাক এবং সে কারণেই তুরস্ক ইরাকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি এ লক্ষ্যে তুরস্ক ইরাকের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিষয়েও উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন সিরিয়া ও ইরাকের কোনো কোনো অঞ্চলের ওপর তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গি আধিপত্যকামী বা মোড়লিপনাসুলভ এবং এসব ভূখণ্ডের ওপর তুরস্কের লোলুপ দৃষ্টি থাকতে পারে।

আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ওপর বাঁধ নির্মাণের তুর্কি নীতির কারণে ইরাক ছাড়াও সিরিয়া ও ইরানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং তুরস্ক নিজেও এতে পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকার হতে বাধ্য। তুরস্ক তার প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ছাড় আদায়ের জন্য পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে এ বিষয়টিও একটি আন্তর্জাতিক সংকটের রূপ নিতে পারে। এসব বিবেচনায় এরদোয়ানের এই সফর দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার হাত প্রসারিত হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছে।

উল্লেখ্য, ডেভেলপমেন্ট রোড শুধু ইরাকই নয়, এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে তুরস্ককে নতুনভাবে যুক্ত করবে বলে জানান ওমের বোলাত। তিনি বলেন, ডেভেলপমেন্ট রোড প্রজেক্টের লক্ষ্য হলো উপসাগরীয় দেশ ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য, শুল্ক, ভিসা ও পরিবহন প্রক্রিয়া আরো সহজ করা। প্রকল্পটি ২০২৫-২৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। রেল ও সড়কপথ ২০৩০ সালে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। তুর্কি এ মন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন সড়ক প্রকল্পের জন্য, উচ্চগতির পরিবহনে পণ্য ও যাত্রীর চলাচলের জন্য প্রায় ১ হাজার ১৭৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে, পাশাপাশি ১ হাজার ১৯০ কিলোমিটার হাইওয়ে নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি তুরস্কের রপ্তানি ও সরবরাহের ক্ষমতাকে ইরাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ সড়কের মাধ্যমে ইরাকের বিভিন্ন প্রদেশ, আল-আনবার শহর ও পারস্য উপসাগরে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে রপ্তানি সম্প্রসারণ করবে বলেও আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে ইব্রাহিম খলিল সীমান্ত ক্রসিংয়ের মাধ্যমে তুরস্ক ও ইরাকের বাণিজ্য হয়ে থাকে। তবে ওভাকয় সীমান্তে নতুন ক্রসিং তৈরির পরিকল্পনা চলছে। মন্ত্রী ওমের বোলাত বলেন, যোগাযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পাশাপাশি যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close