জান্নাতুল আদন

  ২১ মে, ২০২৪

মেডিটেশন

স্ট্রেসমুক্ত আত্মনিমগ্নতার পথ

মঠের গুরুজীর কাছে গুরুতর অভিযোগ জানালেন শিষ্যরা। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ‘পাপ’ কবিতায় ফেরেশতারা যে অভিযোগ করেছিলেন, খানিকটা তেমনি। ‘দিন-রাত নাই এত পূজা করি, এত ক’রে তাঁরে তুষি,/তবু তিনি যেন খুশি নন- তাঁর যত স্নেহ দয়া ঝরে/পাপ-আসক্ত কাদা ও মাটির মানুষ জাতির ’পরে!’ পার্থক্য এটুকু, ওখানে পুরো মানবজাতি, এখানে একজন নির্দিষ্ট শিষ্যের প্রতি গুরুজীর গভীর অনুরাগ নিয়ে অন্য শিষ্যদের অন্তর্দহন! তাদের ধারণা, গুরুজীর এই অনুরাগ অন্যায়ের সমপর্যায়!

অভিযোগ শুনে গুরু হাসলেন। বললেন, আচ্ছা! তোমাদের ধারণা এ রকম! তোমাদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি ঠিক করো। তাকে (অভিযুক্ত শিষ্য) আর তোমাদের প্রতিনিধিকে আমার কাছে নিয়ে এসো। গুরুর আদেশ পালন করলেন শিষ্যরা। দুজন একসঙ্গে এলেন গুরুর সামনে।

দুজনকেই গুরু এক পয়সা করে দিলেন। বললেন, মঠের ওই যে কোনায় দুটো ঘর আছে। তোমরা দুজন যার যার মতো করে এই এক পয়সা দিয়ে খালি ঘর দুটি পূর্ণ করবে। সন্ধ্যায় আমি দেখতে আসব।

প্রতিনিধি শিষ্য তো অস্থির হয়ে উঠলেন, এই এক পয়সা দিয়ে কীভাবে এত বড় ঘর পূর্ণ করবেন! শহরের বাজারে যা দাম জিনিসের! দূর গ্রামে চলে গেলেন। অনেক পরিশ্রম করে, দরদাম করে এক পয়সা দিয়ে বেশ কিছু পুরোনো জঞ্জালসম আসবাব এনে ঘর ভর্তি করলেন।

ওদিকে অভিযুক্ত শিষ্য ভাবলেন, গুরু কখনো অন্যায় দায়িত্ব দেবেন না। তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন। গুরুবাণীর মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করলেন। ধ্যানের স্তরে হঠাৎ তিনি গুরুর কথা বুঝতে পারলেন। বাজারে গিয়ে এক পয়সা দিয়ে মোমবাতি কিনে নিয়ে এলেন।

সন্ধ্যায় গুরু এলেন। প্রতিনিধি শিষ্যের ঘর দেখলেন। যত রাতের অন্ধকার বাড়ছে, তার পুরোনো আসবাবগুলোকে তত অদ্ভুত লাগছে! আর অভিযুক্ত শিষ্যের ঘরে গিয়ে দেখলেন, যত রাত বাড়ছে মোমবাতির আলোয় ঘর তত পূর্ণ হচ্ছে! গুরুকে আর কিছু বলতে হলো না, শিষ্যরা উপলব্ধি করলেন, কেন অন্য শিষ্যদের চেয়ে অভিযুক্ত শিষ্যের প্রতি অনুরাগ বেশি। যেমন শেষ পর্যন্ত ফেরেশতারা উপলব্ধি করেছিলেন, হারুত-মারুতের কর্মকাণ্ড দেখে!

দৈনন্দিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আমরাও অনেক সময় প্রতিনিধি শিষ্যের মতো অস্থির হয়ে উঠি। এ অস্থিরতা আমাদের মনের ঘরে জঞ্জাল বাড়ানো ছাড়া আর কোনো কল্যাণ করে না। কেননা, জীবন প্রত্যেকের কাছে তার মতো করে বাস্তবতা নির্মাণের উপাদান তুলে দেয়। এ উপাদানগুলো দিয়ে কি বাস্তবতা নির্মিত হবে, তা নির্ভর করে উপাদানগুলো ব্যবহারে মানুষের সিদ্ধান্তের ওপর। এখানেই সুস্থির হয়ে মেডিটেশনে আত্মনিমগ্ন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা।

জীবন বাস্তবতায় এমন নাভিশ্বাসের পরিস্থিতিগুলো প্রত্যেকের জীবনেই আসে, যখন মনে হয়, মুক্তির উপায় কী! স্ট্রেস, বিষণ্ণতা, হতাশা বা ডিপ্রেশন ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এই আর্তনাদের সময়গুলোতে মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বিপন্ন অনুভব করে। হয়ে ওঠে নানা বিষয় নিয়ে অভিযোগপ্রবণ। ভুলে যায়, যেকোনো পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সামর্থ্য জন্মগতভাবেই তার মধ্যই দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল জার্নাল সাইকিয়াট্রিতে ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে স্কুলের শিক্ষার্থীদের ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ স্ট্রেসে জর্জরিত। ডিজ্যাবিলিটি নিয়ে কাজ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এমন একটি প্রতিষ্ঠান অ্যাডের মতে ১৫-৩৫ শতাংশ বাংলাদেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।

তথ্য-উপাত্তের পরিসংখ্যান ছাড়াও আমাদের ও পরিচিতদের দৈনন্দিন জীবন থেকে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সহজ পথ হচ্ছে মেডিটেশন। মেডিটেশন নিজেকে বোঝার ও নিজের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। মনের জঞ্জাল সাফ করে ভালো ভাবনাগুলোকে স্থির হওয়ার সুযোগ করে দেয়। ফলে ভালো ভাবা, ভালো বলা, ভালো করা ও ভালো থাকার পথ উন্মোচিত হয়।

মেডিটেশনের এই সর্বজনীন কার্যকারিতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশে ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালিত হয়ে আসছে। গুরুত্ব বিচার করে আপনিও মেডিটেশন চর্চা শুরু করতে পারেন। আত্মনিমগ্ন হয়ে অভিযুক্ত শিষ্যের মতো হয়তো আপনিও উপলব্ধি করবেন, সুখী বাস্তবতা নির্মাণে আপনার আয়ত্তে থাকা উপাদানগুলোর সঠিক ব্যবহার।

আমাদের দেশে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমে লাখো মানুষকে আলোকিত জীবনের সন্ধান দিয়েছে কোয়ান্টাম। তাদের ওয়েবসাইট (quantummethod.org.bd) থেকে ফ্রি ডাউনলোড করে যেকোনো সময় মেডিটেশন চর্চা শুরু করতে পারেন। মেডিটেশন চর্চার মধ্য দিয়ে সবার হৃদয়ে প্রোথিত হোক ভালো মানুষ, ভালো দেশ স্বর্গভূমি বাংলাদেশের স্বপ্ন।

লেখক : গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close