সাকিবুল হাছান

  ২১ মে, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শিশুদের ওপর বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদ। মহামারির মতো সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা। অর্থনৈতিক অশান্তির কারণে ভাঙন ধরেছে অনেক সংসারে। স্বার্থের সংঘাত, অর্থের অভাব, পর নর-নারীতে আসক্ত ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়া, যৌতুক, মতের অমিল আর আত্মসম্মান মোকাবিলায় চূড়ান্ত হচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদ।

জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে, সে হিসেবে প্রতি ৩৮ মিনিটে একটি দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ডিভোর্সই দিচ্ছেন নারীরা, ৩০ শতাংশ দিচ্ছেন পুরুষরা। তবে এটা শুধু শহরের হিসাব। গত ১০ বছরে শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকাতেই প্রায় ৯৩ হাজার ডিভোর্সের আবেদন জমা পড়েছে। এই বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব কাদের ওপর সবচেয়ে বেশি?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিক্ষিত নারীদের নিয়ে সংসার পরিচালনা করতে এখনো প্রস্তুত নন ছেলেরা। তারা শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে চান, কিন্তু শিক্ষিত মেয়ের চাকরিজীবন, তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, তাকে কিছু বিষয়ে সহযোগিতা করা- এসবে পূর্ণ স্বাধীনতা বা সহযোগিতা করতে নারাজ স্বামীরা। ফলে একটি শিক্ষিত মেয়ের যখন আত্মসম্মানে আঘাত আসে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন ডিভোর্সের। যেহেতু সমঝোতা শুধু নারীকেই করতে হয়, তাই মেয়েটি বেছে নেন একাকিত্বের জীবন। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনরা বলেছেন, শহরে ডিভোর্সের মধ্যে নারীরা এগিয়ে থাকলেও সেটা সারা দেশের চিত্র নয়। নিম্নবিত্তের বিয়ে বা ডিভোর্সের কোনো তথ্য নথিভুক্ত সব সময় হয় না। তবে নিম্নবিত্তের মধ্যে স্বামীরাই ডিভোর্স দিচ্ছে বেশি। ডিভোর্স দেওয়ার প্রস্তাব যার থেকেই আসে না কেন, এর প্রভাবটা কাদের ওপর বেশি পড়ছে সে বিষয়ও চিন্তা করা খুবই জরুরি।

বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে শিশুদের ওপরে। বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানরা। এমন পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তানরা বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। বিচ্ছেদের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশু, নবজাতক থেকে টিনএজার, বেড়ে ওঠার ওপর নানা বিষয় প্রভাব রাখে। তাদের ব্যক্তিত্ব সঠিকভাবে গড়ে উঠে না। পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়। শিশুরা পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যায়, আবেগ ও মানসিক উন্নয়নে তীব্র বাধাগ্রস্ত হয়।

বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে সমগ্র পরিবারের জন্য আবেগগত অশান্তি সৃষ্টি করে, কিন্তু বাচ্চাদের জন্য পরিস্থিতি খুব ভীতিকর, বিভ্রান্তিকর এবং হতাশাজনক হতে পারে, ফলে তাদের শারীরিক, মানসিক এবং শিক্ষাকার্যক্রমসহ বিভিন্নভাবে সন্তানদের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। বিচ্ছেদের ফলে সন্তানদের মধ্যে বিষণ্ণতা দেখা যায়। তারা চিন্তা করে আমার বাবা-মা কেউই নেই, আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, যার কারণে তারা পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারে না। সেই সঙ্গে শিক্ষার ব্যয়ও বহন করতে পারে না, ফলে তারা পড়াশোনা থেকে দূরে চলে যায়। অনেক সন্তান মা-বাবার বিচ্ছেদ সহজে মেনে নিতে পারে না। ফলে তারা বিভিন্ন মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। তারা নিজেকে অপরাধী মনে করে। যেই পরিবারের বাবা-মায়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকে না, সেই পরিবারের সন্তানরা একটি অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করে।

স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের স্বাস্থ্যকে বুঝি। কিন্তু যখন মা-বাবার মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হয়, তখন মানসিক সমস্যার পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। সন্তানরা লালিতপালিত হয় পরিবারে। কিন্তু পরিবার যখন ভেঙে যায়, তখন সন্তানরা বিপাকে পড়ে। ফলে সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের অনীহা চলে আসে। তাদের আচরণের মধ্যেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অনেকে খারাপ আচরণ কিংবা অপরাধপ্রবণ কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়। কারণ তাদের গাইড করার মতো কেউ থাকে না।

আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ কিন্তু ভবিষ্যতে পৌঁছানোর আগেই যদি বিবাহবিচ্ছেদের ফলে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাহলে সেই শিশুদের দিয়ে দেশ ভালো কিছু আশা করতে পারবে না। তাই যেভাবেই হোক এই বিচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে। বিবাহবিচ্ছেদ এড়াতে কার্যকর উপায় হলো- আর্থিক ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ দাম্পত্য জীবনে ঝগড়ার শুরুটাই হয় চাহিদার চেয়ে অর্থের জোগান কম হলে। বিবাহবিচ্ছেদ এড়াতে স্যাক্রিফাইস করার মনমানসিকতা রাখতে হবে। প্রিয় মানুষটার জন্য একটু ছাড় দিন। ঘরের কাজগুলো একসঙ্গে করুন। কখনোই একজনের ওপর সব কাজ চাপিয়ে দেবেন না। বিবাহবিচ্ছেদ এড়াতে অকারণে সন্দেহ নয়। অন্যকে সন্দেহ করার আগে তার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করুন। আর বড় কথা হলো, কখনোই পরকীয়া করা যাবে না। কারণ বর্তমানে পরকীয়ার কারণে বিবাহবিচ্ছেদের হাড় সবচেয়ে বেশি।

আপনজনের মানসিক নৈকট্য বা শারীরিক স্পর্শ শিশুর জন্য খুব দরকার। এর ওপর নির্ভর করবে শিশুদের বড় হওয়া এবং অন্য ব্যক্তি ও সমাজের প্রতি শিশুর মধ্যে কতটুকু আকর্ষণ গড়ে উঠবে সেটা। বিবাহবিচ্ছেদ একটা সুন্দর পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। বাবা-মায়ের ভাবতে হবে বিচ্ছেদ হলে শুধু তাদেরই ক্ষতি হয় না, তাদের সন্তানরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সন্তানদের কথা চিন্তা করে বিবাহবিচ্ছেদ কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিবাহবিচ্ছেদ এড়াতে নিজে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close