প্রকাশ ঘোষ বিধান

  ২০ মে, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

প্রকৃতির জন্য মৌমাছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

প্রকৃতির জন্য মৌমাছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। মৌমাছি বা মধুমক্ষিকা বা মধুকর বোলতা এবং পিঁপড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মধু সংগ্রহকারী পতঙ্গবিশেষ। মধু ও মোম উৎপাদন এবং ফুলের পরাগায়ণের জন্য প্রসিদ্ধ। পৃথিবীতে ৯টি স্বীকৃত গোত্রের অধীনে প্রায় কুড়ি হাজার মৌমাছি প্রজাতি আছে, যদিও এর বেশির ভাগেরই কোনো বর্ণনা নেই এবং এর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশে যেখানেই পতঙ্গ-পরাগায়িত সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে, সেখানেই মৌমাছি আছে। দেশে সচরাচর চার প্রকার মৌমাছি দেখা যায়। রকি বা পাহাড়ি মৌমাছি, লিটল বী বা খুদে মৌমাছি, ইন্ডিয়ান বি বা ভারতীয় মৌমাছি ও ইউরোপিয়ান বি বা ইউরোপীয় মৌমাছি। এগুলো ছাড়াও কেরেলায় আর একটি প্রজাতি পাওয়া যায়, যারা হুলবিহীন মৌমাছি নামে পরিচিত। এরা আদৌ হুলবিহীন নয়, প্রকৃতপক্ষে এদের হুল পূর্ণ বিকশিত হয় না। তবে এরা খুব ভালো পরাগসংযোজক। এরা বছরে ৩০০-৪০০ গ্রাম মধু উৎপাদন করে।

যেখানেই সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে, সেখানেই দেখা মিলবে মৌমাছির। এরা অত্যন্ত কর্মঠ ও বুদ্ধিমান। কারণ মৌমাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের কারণে গাছে ফুল ফোটে, ফল হয়। মৌমাছির মতো কীটপতঙ্গ না থাকলে গাছে ফুল ফুটত না, ফল হতো না। প্রায় ৯০ ভাগ বন্য উদ্ভিদে পরাগায়ণ ঘটায় মৌমাছি।

বিশ্ব মৌমাছি দিবস ২০ মে পালিত হয়। ১৭৩৪ সালের এই দিনে মৌমাছি পালনের প্রবর্তক আন্তন জানসা জন্মগ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক দিবসের উদ্দেশ্য হলো বাস্তুতন্ত্রের জন্য মৌমাছি এবং অন্য পরাগায়ণকারীদের ভূমিকাকে স্বীকার করা। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো ডিসেম্বর ২০১৭ সালে ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য স্লোভেনিয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে। তখন থেকে এই তারিখে দিবসটি পালন করা হয়।

মৌমাছিরা দলবদ্ধভাবে উপনিবেশে বাস করে। প্রত্যেকটি মৌচাকে মৌমাছিরা বসতিবদ্ধ হয়ে একটি বড় পরিবার বা সমাজ গড়ে বাস করে। একটি চাকে বা দলে থাকে তিন ধরনের মৌমাছি। রানি মৌমাছি, শ্রমিক মৌমাছি ও পুরুষ মৌমাছি। রানি মৌমাছি দলের নেতা ও আকারে সবচেয়ে বড়। সম্পূর্ণ দলকে গাইড করার পাশাপাশি পরবর্তী রানি মৌমাছি জন্ম দেওয়া তার কাজ। শ্রমিক মৌমাছিদের কাজ ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা এবং নিজেদের চাক বানানো। সব শ্রমিক মৌমাছিই নারী। এই শ্রমিক মৌমাছিগুলোকেই আমরা বাইরে উড়তে দেখি। আর পুরুষ মৌমাছির কাজ রানির আশপাশে থাকা। তবে গ্রীষ্ম ও বসন্তকাল ছাড়া বাকি মৌসুমে পুরুষ মৌমাছিরা অলস সময় কাটায়। রানি মৌমাছি বাঁচে গড়ে পাঁচ বছর। গ্রীষ্মকালে রানি মৌমাছি সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। এ সময় প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৫০০টি ডিম পাড়ে রানি মৌমাছি। রানি মৌমাছি মারা গেলে শ্রমিক মৌমাছিরা সদ্য জন্মানো একটি রানি মৌমাছিকে বাছাই করে। তাকে রয়্যাল জেলি নামে একধরনের বিশেষ খাবার খাওয়ানো হয়। ফলে দ্রুত বড় হতে থাকে মৌমাছিটি। এটিই প্রাপ্তবয়স্ক হলে রানি মৌমাছির জায়গা দখল করে।

মৌমাছি সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার মধুর জন্য। কিন্তু এই মধু আমাদের জন্য তৈরি করে না মৌমাছিরা। বরং শীতকালে নিজেদের খাওয়ার জন্য তারা মধু সংগ্রহ করে রাখে। প্রয়োজনের তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি মধু উৎপাদন করে রাখে এরা। আর সুযোগ বুঝে সেই অতিরিক্ত মধুই আমরা নিয়ে নিই। মৌমাছি গড়ে এক থেকে দেড় মাস বাঁচে। এ সময়ের মধ্যে প্রতিটি মৌমাছি প্রায় ১/১২ চা চামচ মধু সংগ্রহ করে, যা প্রায় শূন্য দশমিক ৮ গ্রামের সমান।

মৌমাছির চাকের গঠন ষড়ভূজাকার হওয়ায় গবেষকরা ভাবতেন, মৌমাছি বুঝি জ্যামিতি জানে। বিস্ময়করভাবে গবেষণা করে দেখা গেছে, মৌমাছিরা যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করতে পারে। মৌমাছিও কিন্তু অঙ্ক কষতে পারে। মৌমাছির চাকের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন। এদের চাকের ভেতরে থাকে মধু রাখার ছোট ছোট কুঠুরি। কুঠুরিগুলো ষড়ভূজাকার। এই জ্যামিতিক আকৃতির কুঠুরিতেই সবচেয়ে বেশি মধু রাখা যায়। ষড়ভূজাকার না হয়ে বৃত্তাকার বা গোলাকার হলে এত মধু ধরত না।

মৌমাছির হুল ফুটানো বিষ খুবই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু মৌমাছির হুল থেকে সংগৃহীত বিষ রোগ নিরাময়ের উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে বলে গবেষকরা দাবি করেছেন। নিউজিল্যান্ডের নেলসন হানি অ্যান্ড মার্কেটিং নামীয় একটি কোম্পানি জানিয়েছে, গেঁটে বাতজনিত ব্যথা নিরাময়ে প্রদাহনিরোধক হিসেবে কাজ করে মৌমাছির বিষ।

বাংলাদেশে পরাগরেণু ও সুধার উৎস হিসেবে বিচিত্র রকমের উদ্ভিদ রয়েছে। এ দেশের অনুকূল আবহাওয়ায় মৌমাছি সারা বছর এসব উদ্ভিদ থেকে খাদ্য আহরণ করে জীবন চক্র অব্যাহত রাখতে পারে। বাংলাদেশে বার্ষিক ৩০ হাজার টন মধুর চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১০ হাজার টন। আমাদের দেশে উৎপাদিত মধুর শতকরা ৭৫ ভাগ আসে সুন্দরবন থেকে। সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য বনাঞ্চলের সপুষ্পক উদ্ভিদে সুধা ও পরাগরেণুর অবারিত উৎস রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি চাষ করে মধু, মোম, মৌকাই, রাজচিত মোরব্বা রস, পরাগরেণু ও গরল সংগ্রহ ও বিক্রি করে অর্থ উপার্জন এবং মৌকলোনির মাধ্যমে ফসলের পরাগায়ণে ব্যবহার করে ফসলের অধিক ফলনপ্রাপ্তি সম্ভব।

প্রায় ৩ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে মৌমাছি টিকে আছে। প্রতিটি মৌমাছির চাকে গড়ে ৫০ হাজার মৌমাছি থাকে। ১ কেজি মধু সংগ্রহ করতে প্রায় ৪০ লাখ ফুলে ঘুরতে হয় মৌমাছিদের। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছিরা তাদের পা এবং বুকের লোমের ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়লে পরাগায়ণ ঘটে, যার ফলে উৎপন্ন হয় ফল। এভাবে মৌমাছিরা পরাগায়ণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ফল ও ফসলের উৎপাদন বাড়ায়। আমাদের দেশে সরিষা, পেঁয়াজ, ধনে, গুয়ামৌরী, কালোজিরা, লিচু, বড়ই, তুলা প্রভৃতি ফসলের জমিতে মৌকলোনি স্থাপন করে এসব ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মৌকলোনির উপজাত সংগ্রহ ও বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও টেকসই জীবিকার জন্যও মৌমাছি পালন করা দরকার। মৌমাছি সম্পর্কে আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, প্রকৃতি থেকে মৌমাছি উধাও হলে মানবজাতি সর্বোচ্চ চার বছর টিকে থাকতে পারবে। এ উদ্ধৃতি থেকেই বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণে মৌমাছির গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। মৌমাছি পরাগায়ণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা দানের মাধ্যমে দেশের ফল ও ফসলের উৎপাদনে পরোক্ষভাবে সহযোগিতাদান করা যায়। কিন্তু কৃষিজমিতে অতিবিষাক্ত ও মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার, কৃষিজমি ও বনভূমি হ্রাস, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং এক ফসলি চাষ মৌমাছির প্রাকৃতিক আবাসস্থল, স্বাভাবিক বিচরণ ও প্রজননে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। প্রকৃতির জন্য মৌমাছি সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close