মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ২০ মে, ২০২৪

বিশ্লেষণ

জনসচেতনতা কমাতে পারে বজ্রাঘাতে মৃত্যুহার

বজ্রপাতে মৃত্যু দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। বর্ষাকাল এলে আকাশ কখনো ঘনকালো মেঘে ছেয়ে যেত। চমকাতো বিদ্যুৎ, শোনা যেত বজ্রপাতের বিকট শব্দ। বেশির ভাগ বজ্র তখন আকাশেই মিলিয়ে যেত। কদাচিৎ দু-একটা মাটিতে এসে পড়তেই দেখা যেত উঁচু তাল কিংবা সুপারিগাছের মাথায় এসে ঠেকে গেছে। বজ্রবিদ্যুতের আঁচে শুকিয়ে যেত গাছের পাতা। কিন্তু আজকাল বজ্র যেন যমদূতের রূপ ধারণ করে সব মাটিতে এসে ঠেকছে, মেরে ফেলছে মানুষ। প্রকৃতি রুদ্ররোষে বিপর্যস্ত মানুষ সম্প্রতি প্রবল তাপপ্রবাহে যখন দিশাহারা তখন দেশের কোথাও স্বস্তির বৃষ্টিতে খনিকটা উৎফুল্ল, ঠিক তখনই দেখা দিল বিপত্তি। গেল ২ মে বজ্রপাতে কক্সবাজারের পেকুয়ায় দুজন, রাঙ্গামাটিতে তিনজন, কুমিল্লায় চারজন, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় একজন এং সিলেটের কানাইঘাটে একজনের মৃত্যু ঘটে। সূত্র মতে জানা যায়, গত ১০ বছরে দেশে প্রায় ৩ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এটাকে কি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নেওয়া যায় না। আবহাওয়াবিদদের মতে, বর্তমান সময়ে বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। এ ছাড়া নদী ও জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া, গাছপালা ধ্বংস হওয়ার কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত ঘটায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রলায়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে ২ হাজার ১৬৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়, অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর ২১৬ জনের বেশি মানুষ বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করে। ২০২১ সালে সারা দেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৬২ জন মানুষ। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বজ্রপাত হতে দেখা গেলেও মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বেশি বজ্রপাত হয়। সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ২৪ হাজার মানুষের বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়। ১৯১৬ সালে বজ্রপাতের ঘটনা অনেক বেশি ঘটেছে। ওই বছরের মে মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একই দিনে ৫৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। আর ৬ জুন এক দিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ হারিয়েছেন ২৫ জন। এরপরই ২০১৬ সালের ১৭ মে বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেব অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

যারা ঘরের বাইরে কাজ করেন, যেমন কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষই বেশি বজ্রপাতের শিকার হন। প্রাকৃতিক কারণেই বজ্রমেঘের সৃষ্টি এবং বজ্রমেঘ থেকেই হয় বজ্রপাত। ‘কিউমুলোনিম্বাস’ মেঘ থেকে সাধারণত বজ্রপাতের সৃষ্টি। বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বজ্রমেঘের পরিমাণও বেড়েছে কয়েক বছর ধরে। পরিবেশদূষণও গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। বাংলাদেশে বজ্রমেঘ বৃদ্ধির সময়টা এপ্রিল ও মে মাস। গবেষণা বলছে, ভৌগোলিক ও আবহাওয়াজনিত কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে বজ্রপাত বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। তবে মৌসুমগত আবহাওয়ার পরিবর্তনই বজ্রপাতের মূল কারণ। এ জন্য জুন-জুলাইয়েও বজ্রপাতের বড় বড় ঘটনা ঘটে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বজ্রপাতে যত লোক মারা যাচ্ছে, তার এক-চতুর্থাংশই মারা যাচ্ছে বাংলাদেশে। সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা বেশি। আবহাওয়াবিদদের মতে, সত্যিকারে বজ্রপাত হয় অনেক বেশি, তবে সব বজ্র মাটি পর্যন্ত স্পর্শ করে না বলে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। দেশে গাছপালা কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ১ থেকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়ে চলেছে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও। আবহাওয়ার উত্তাপ বাড়াকে বজ্রপাতের অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হয়। আবার সেলফোনের অসংখ্য টাওয়ার নির্মাণও বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকে। এ ছাড়া মানুষের হাতে হাতে রয়েছে সেলফোন। গ্রামগঞ্জে নির্মিত হয়েছে বৈদ্যুতিক টাওয়ার। বাড়ছে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার। শীতের পরে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে শুকনো গরম বাতাস আসতে শুরু করে। অন্যদিকে হিমালয় থেকে আসে ঠাণ্ডা বাতাস। এ দুই ধরনের বাতাসের সংমিশ্রণে এক রকম অস্থিতিশীল বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি তৈরি। মেঘ চলাচলের সময় বাতাস এক মেঘের সঙ্গে অন্য মেঘের ঘর্ষণের সৃষ্টি করে, যার ফলে বজ্রের সৃষ্টি হয়। বজ্র যখন মাটি অবধি চলে আসে তখনই তাকে বজ্রপাত বলে অভিহিত করা হয়। আবহাওয়াবিদের মতে, ঊর্ধ্বাকাশে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকার সময়ে উত্তর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহের কারণে একদিক থেকে গরম ও আর্দ্র বাতাস আর অন্যদিক থেকে শীতল বাতাস প্রবাহে বজ্রপাত হয়, যা অল্প সময়ে তীব্র রূপ নিতে পারে।

বজ্রপাত সাধারণত চার রকমের হয়ে থাকে। প্রথম হলো, বজ্রপাত সরাসরি আকাশ থেকে মাটিতে চলে আসে। এ ধরনের বজ্রপাতই বেশি প্রাণহানি ঘটায়। অন্য তিনটি হলো, আকাশ থেকে আকাশে, এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে এবং অন্যটি মেঘের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। উঁচু স্থানে বজ্রপাত বেশি হয়। আগে গ্রামগঞ্জে বট, তাল ও নারকেলগাছের মতো উঁচু গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল। তালগাছের মতো উঁচুগাছ বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে কাছে টেনে নিয়ে বজ্রপাত ঠেকিয়ে দিত। ফলে বজ্র মাটির কাছে খুব একটা পৌঁছাত না। তাই বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুও কম ঘটত। বজ্রপাত ঠেকাতে রাস্তার পাশের চেয়ে খোলা মাঠের তালগাছই বেশি কার্যকর বলে মনে করেন অভিজ্ঞজন। গ্রামগঞ্জে রাস্তার দুপাশে তালগাছের যে দীর্ঘ সারি একসময় চোখে পড়ত, তাও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। এখন উঁচু গাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বজ্র সরাসরি মাটিতে লোকালয়ে এসে পড়ে এবং মানুষের মৃত্যু ঘটায়। বজ্রপাতের কারণে সাধারণত দুটি উপায়ে মানুষের মৃত্যু হয়। একটি কারণ প্রত্যক্ষ বা সরাসরি আঘাত, যা মানুষের শরীরের ওপর সরাসরি পড়ে। এ ধরনের ঘটনা কম ঘটে এবং প্রত্যক্ষ কারণে মানুষের মৃত্যুও কম। পরোক্ষ বজ্রাঘাতেই অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এ ক্ষেত্রে যেখানে বজ্রপাত আঘাত হানে সেখানকার পুরো জায়গাটি বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়। ভূমির এ ধরনের বিদ্যুতায়নে বেশির ভাগ মানুষ মারা যায়। বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর ২০১৭ সালে বজ্রপাতে প্রাণহানি হ্রাসে সরকার দেশব্যাপী ৬০ লাখ তালগাছ লাগানো হয়। উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে গাছগুলো বেড়ে উঠতে পারেনি। এরপর ২০১৬ সালে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র লাইটনিং ডিটেক্টিভ সেন্সর স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। দীর্ঘ ৫ বছর পর ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের আটটি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয় বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দেওয়ার এই অত্যাধুনিক যন্ত্র। এ যন্ত্রের সেন্সরগুলোতে ধারণ করা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে বিদ্যুৎ চমকানো এবং বজ্রপাতের মাত্রা জানা সম্ভব। কোন এলাকায় কতক্ষণ ধরে বজ্রপাত হবে বা হয়েছে সে-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট তথ্য মিলবে। প্রতিটি ২৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের সেন্সর থেকে ১ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত মনিটরিং করা যাবে। বজ্রপাত-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ামাত্র তাৎক্ষণিকভাবে তা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রচার করা হবে। মোবাইলে ওয়েদার অ্যাপের মাধ্যমে যে কেউ সে তথ্য জেনে নিতে পারবে। বজ্রপাতে মৃত্যুরোধে এসব কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে তা দেখার বিষয়।

বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইচ্ছে করলেই প্রতিরোধ করা যাবে না। তবে বজ্রপাতে মৃত্যুহার কমাতে অবশ্যই বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতের মেঘের প্রকাশ বেশ জটিল। মাত্র আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা আগে এর সম্পর্কে বলা যায়। বজ্রঝড় সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। এ সময় বাড়ির বাইরে বের না হওয়া শ্রেয়। ঘরে থেকে দরজা, জানালা বন্ধ রেখে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে নিতে হবে। বজ্রপাতের সময় ঘরের বাইরে অবস্থান করলে খোলা মাঠে বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। একান্তই যদি থাকা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, তবে পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে কানে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব কোনো ভবন বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ। বজ্রপাতের সম্ভাবনা দেখা দিলে উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা তার, সেলফোন টাওয়ার থেকে দূরে চলে যেতে হবে। এমনকি আকাশে ঘন মেঘে বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখলে নদী, পুকুর বা ডোবা এবং যেকোনো জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। এসব স্থান বজ্রকে বেশি আকর্ষণ করে। বজ্রপাতের সময় গাড়ি বা বাসের ভেতর থাকলে কোনো ধাতব অংশকে শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা যাবে না। বজ্রপাতের সময় লোহা বা অন্য ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহারও নিরাপদ নয়। একইভাবে বজ্রপাতের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ স্পর্শ করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় সেলফোন ও কম্পিউটার ব্যবহার এবং টেলিভিশন দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। ফ্রিজসহ সব রকম বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সুইচ বন্ধ রাখতে হবে। তা না হলে বজ্রপাতে এসব নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে প্রতিটি ভবনে বজ্রপাতনিরোধক দণ্ড রাখা বাধ্যতামূলক করা দরকার। বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে হাওর অঞ্চলে টাওয়ার নির্মাণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার নামিয়ে আনতে সরকারের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি জোরদারের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে দেশের সর্বত্র বেশি করে উঁচু গাছ যেমন তাল, নারিকেল, সুপারি, খেজুরগাছ লাগাতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে বসাতে হবে লাইটনিং টাওয়ার বা উঁচু ধাতব পোস্ট। খোলা স্থানে উঁচু টাওয়ারে আরথিং করে নিলে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। বজ্রপাত সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে পারলে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close