আলমগীর খোরশেদ

  ১৭ মে, ২০২৪

ইতিহাস-ঐতিহ্য

ঘাটু বা গাঁডু গান

ষাটের দশক বা তারও আগে যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামে, তাদের গ্রামীণ স্মৃতিচারণে স্কুল, বাজারে নাটক, যাত্রাপালা, কবিগান, কিচ্ছার আসর, পুঁথিপাঠসহ ঘাটু বা গাঁডু গান মিশে আছে গল্পের অনুষঙ্গ হয়ে। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। ইন্টারনেট, মোবাইল কি শুনেইনি মানুষ। সন্ধ্যা হতেই আঁধারে ছেয়ে যেত গ্রামীণ জনপদ। ব্যাটারিচালিত টর্চলাইট, বড় কৌটায় কেরোসিনের নাল বাতি, হারিকেন, বাজারে দোকানে হ্যাজাইক লাইটের আলোই ছিল ভরসা। নানা কুসংস্কার, গ্রামীণ রীতিনীতিতে চলত মানুষের জীবননদী। বর্ষার সময় জমিতে পানি, রাস্তাঘাট ডুবিয়ে দিয়ে মানুষদের অলস করে দিত। কোনো কাজকর্ম থাকত না। তখন ধনীশ্রেণি বা জমিদার, তালুকদাররা আয়োজন করতেন গানের আসর। শীতকালে ধান মাড়াই শেষ হলেও বসত বিনোদনের বিভিন্ন আড্ডা। ঘাটু বা গাঁডু গান তাদের মধ্যে একটি।

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের নদীবাহিত এলাকার বিলুপ্তপ্রায় পল্লীসংগীত, যা ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এই গান গাওয়া হয়, তাকেই গাঁডু গান বলা হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন—ঈশ্বরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কেন্দুয়া, সিলেট ও সুনামগঞ্জে গাঁডু গানের প্রচলন ছিল। ষোড়শ শতকের শেষদিকে গাঁডু গানের যাত্রা শুরু। গবেষণা মতে, ধারণা করা হয়—শ্রীকৃষ্ণের প্রেমমগ্ন কোনো এক ভক্ত রাধা সেজে কৃষ্ণের অপেক্ষায় ছিল, তখন তার কয়েকজন ভক্তের মধ্য থেকে ছেলে শিশুদের রাধার সঙ্গী সাজিয়ে নেচে নেচে বিরহের গান পরিবেশন করে, আর এভাবেই প্রচলন হয় গাঁডু গান, যা সুদর্শন ছোট কিশোর ছেলেদের মেয়ে সাজিয়ে গান পরিবেশন করা হতো। এই গানের বিশেষত্ব হলো, ছেলেরা নারী সাজবে, নেচে নেচে বিরহের গান গাইবে।

জানা যায়, প্রায় ১৬০ বছর আগে সিলেটের হবিগঞ্জে এক বৈষ্ণব আখড়ায় গাঁডু গান নামে এক ধরনের গানের প্রচলন হয়, যা সুন্দর চেহারার কিশোর ছেলেমেয়েদের পোশাক পরিয়ে মেয়ে সাজিয়ে নাচাত। এসব ছেলেকে বলা হতো ‘ঘাটুপুত্র’। গাঁডু ছেলেদের নিয়ে দুপক্ষ হয়ে যেত, কে গাঁডু ছেলেকে সঙ্গে রাখবে। ফলে গাঁডু গান গাওয়া ছেলেদের নিয়ে সমাজে নেতিবাচক কথা, নিন্দা চলত। স্কুলে, বাজারে, খোলা মাঠে, আখড়ার কাছে সন্ধ্যা হতেই বসত গাঁডু গানের আসর। যে ছেলেটি মেয়ে সেজে গান করত, পরবর্তী সময়ে সাধারণ জীবনে তার চালচলনে, কথাবার্তায় মেয়েলিপনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না। মেয়েদের মতো হাত নাড়ানো, চোখের পলক ফেলা, তাকানোর ভঙ্গি—সবকিছুতেই মেয়েলিভাব থেকে যেত। ময়মনসিংহ অঞ্চলে গাঁডু গানের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। বিশেষ করে ভাটি এলাকার মানুষ ছয় মাস পানিবন্দি ও ছয় মাস জমি চাষাবাদ করত। পানিবন্দি মানুষ যারা অভিজাত শ্রেণির, তারা আয়োজন করত গাঁডু গানের। ঢোল, খঞ্জনি, পায়ে ঘুঙুর, মেয়েদের পোশাক পরে নাচত যে ছেলে, সেই ঘাটু বা গাঁডু নামে অভিহিত হতো। যেসব ছেলে ঘাটু সাজত, তারা বিকৃতকামী জমিদার বা আয়োজক পুরুষের লালসার শিকার হতো। জমিদাররা তাদের বেশি সময় দিত। ফলে জমিদার গিন্নিরা ঘাটুদের সতীনের চোখে দেখত। গ্রামে যারা থেকেছেন, তারা বলতে পারবেন, এমন অনেক পরিবারে ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক পরিবার ভেঙে গেছে বরের ঘাটুপুত্রদের প্রতি আসক্তিতে। ফলে গাঁডু গান সমাজে তেমন সমাদৃত না হয়ে এর আবেদন ফুরাতে থাকে। তারপরও সব ক্ষেত্রে একই ঘটনা ছিল না। গাঁডু গান চলেছে সারা জনপদে। আনন্দ বিনোদনের অনুষঙ্গ হয়ে। তখন গ্রামে বিনোদন বলতে কাঠের বাক্স বড় রেডিও ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিচ্ছা, পুঁথিপাঠ, নাটক, যাত্রা, বাউল গানের আসর ছাড়া বিনোদন বলতে তেমন কিছুই ছিল না। গাঁডু গান একটা শিল্প, একটা ঐতিহ্য হয়ে গ্রামীণ জনপদের মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে স্মৃতিজাগানিয়া হয়ে। আজকের প্রজন্মকে জানাতে হবে, আমাদের হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে গাঁডু গানও একটি অংশ, যা ছিল শত বছরের ঐতিহ্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close