আরিফ মঈনুদ্দীন

  ২৯ মার্চ, ২০২৪

উপন্যাস (পর্ব ১১)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

রাশেদা আক্তার বললেন, সে-রকম কোনো আলামতের এখনো ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না।

আচ্ছা রাসু, তুমি একটানা দীর্ঘ প্রবাসজীবনে থেকে নিজের দেশ সম্পর্কে এত সুন্দর ধারণা কীভাবে পোষণ করতে পারলে। আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। বউ আমার এমন বিদুষী। অথচ কদর করার সময় পাই না! আমি ব্যবসায়ী, হতভাগা। মানিক চিনলাম না।

তুমি তো আজীবনই রসিকতা করে গেলে। তবে তোমার রসিকতা অন্তঃসারশূন্য নয়, এতে দারুণ প্রাণরস থাকে। আমি ভীষণ উপভোগ করি। যেমন তোমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর এক দিন তুমি আমাকে তোমাদের পূর্বপুরুষের গৌরবগাথা শোনাচ্ছিলে, তোমার কথা শেষ হতে-না-হতেই আমিও আমাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য তোমাকে শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ তুমি আমাকে ঘায়েল করার জন্য যে গল্পটা বলেছিলে মনে নেই-

এক লোক গ্রামের টি স্টলে বসে চুটিয়ে গল্প মারছে। তার দাদার এক গোশালা (গরুর ঘর) ছিল যেখানে গাভিকে ঘরের এ মাথায় প্রজনন করালে গাভি হাঁটতে হাঁটতে ও মাথায় গেলে বাছুর প্রসব করার সময় হয়ে যেত। এত বড় ঘর, তাজ্জব বনে যেতে হয়! আরেক লোক এটা শুনে উপস্থিত একটি গল্প বানিয়ে বলল, আমার দাদার এক লগি ছিল, যেটা দিয়ে আসমানের তারা পাড়তেন। তাই শুনে প্রথম গল্পবাজ বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করল, তাহলে ওই লগিটা রাখত কোথায়? দ্বিতীয় লোকটা সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিল কেন আপনার দাদার গরুঘরে। গল্পবাজ লোকটা মাথা নেড়ে সায় দিল হ্যাঁ, তাহলে তো ঠিক। স্টলের আর যারা ছিলেন সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

হক সাহেব বললেন, রসিকতাণ্ডফসিকতা যা-ই বলো না কেন আমি নিশ্চিত যে, তোমার মতো স্ত্রীর স্বামী হওয়া আসলে শুধু ভাগ্যের ব্যাপার নয়, পুরোপুরি সৌভাগ্যের ব্যাপারই বটে। আর হ্যাঁ, আমাকে কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি।

রাশেদা আক্তার ভ্রু কুঁচকে বললেন, কোন প্রশ্নটা?

ওই যে বললাম, বিদেশবিভুঁইয়ে থেকে কীভাবে তোমার স্বদেশ চিন্তা এত সুন্দর করে মাথায় এলো? শুধু স্বদেশ চিন্তাই বা বলি কেন, আমার যা ধারণা- প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সমাজজীবনের তুলনামূলক বিশ্লেষণে তুমি সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি করা প্রফেসর শফিক সাহেবকেও মনে হচ্ছে ফেল মেরে দেবে।

রাশেদা আক্তার বললেন, সারা বিশ্বে অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগে প্রচারমাধ্যমগুলোর উত্তরোত্তর যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। ইচ্ছে থাকলে যে কেউ এর ফল ভোগ করতে পারে। নিজের মনমেজাজের উৎকর্ষ বিধান করা দরকার। প্রথম শ্রেণির একজন নাগরিক হিসেবে যা জানা এবং বোঝা দরকার তাতে যদি কেউ সমৃদ্ধ না হয় তবে ওই ব্যক্তিকে দিয়ে সমাজে তথা দেশের কোনো উপকার হবে না। সে সমাজের বোঝাস্বরূপ। বিশ্বব্যাপী এই মিডিয়া বিপ্লবের সুবাদে চোখণ্ডকান খোলা রেখে যে কেউ প্রচুর জানতে এবং বুঝতে পারে, যা তার নিজের এবং দেশেরও কাজে আসতে পারে।

হক সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। মনে হচ্ছে স্ত্রীর জ্ঞানগর্ভ আলাপ তার কাছে ভালো লাগছে। বাইরে থেকে এসে এখনো কাপড় ছাড়া হয়নি। ওটা যেন ভুলেই গেছেন। স্ত্রীর কথা শুনে তার মেজাজেও দ্রুত প্রতিক্রিয়া তিনি টের পাচ্ছেন। দেশকে ভালোবাসা নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব এবং উত্তর প্রজন্মের জন্য একে বাসোপযোগী করে যাওয়াও প্রতিটি মানুষের কাছে মানবিক দাবি। আর এজন্য সম্ভব কিছু করতে হলে বিদেশবিভুঁইয়ে এ রকম বেখবর পড়ে থাকা চলবে না। সুনাগরিকত্বের দাবি হলো, যেখানে যে অবস্থায়ই থাকা হোক না কেন, দেশের মঙ্গলের জন্যই সচেষ্ট থাকা। এ প্রসঙ্গে তার মোগল আমলের একটি ঘটনা মনে পড়ল।

সম্রাট ফররুখ শিয়ব অসুস্থ। ভীষণ অসুস্থ। রাজ্যের হেকিমণ্ডবৈদ্য শেষ করে পীর-ফকিরের ঝাড়ফুঁক কিছু বাদ গেল না। কিন্তু কিছুতে শাহানশাহ আরোগ্য হচ্ছেন না। উজির-নাজির সৈন্য-সামন্ত সিপাহসালার সবাই ব্যস্ত, কী করে কোন উপায়ে সম্রাটের আরাম নিশ্চিত করা যায়? এ রাজ্যের হেকিমণ্ডবৈদ্য শেষ- আরেক রাজ্যেরগুলো ডাকো। এ পরগনার পীর-ফকির ফেল মেরেছে তো কী হয়েছে, ওই পরগনার দ্বারস্থ হও। কিন্তু না। বাদশাহর অসুখ দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রাসাদময় শোকের ছায়া। রাজ্যময় খোঁজাখুঁজি- কোথাও কোনো ভালো ডাক্তার পাওয়া যায় কি না? হঠাৎ কে যেন একটা খবর নিয়ে এলেন- একজন বিদেশি ডাক্তারের হদিস পাওয়া গেছে। জাতে ইংরেজ। খাঁটি বিলেতি। সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে এ দেশে এসেছেন নিজেদের লোকজনের চিকিৎসা করার জন্য। ভারী ভারী ডিগ্রিধারী পাস করা ডাক্তার। তৎক্ষণাৎ ওই ডাক্তারকে আনা হলো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close