আলমগীর খোরশেদ

  ২৯ মার্চ, ২০২৪

গ্রামীণ ঐতিহ্য

গ্রামের বাড়িঘর

আবহমান গ্রামবাংলায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা যাদের, তারা গ্রামীণ পরিবেশ, সমাজ, জনপদ, আবাসস্থলে ধনী-গরিব মিলেমিশে বাস করেন একে-অন্যের আত্মার বন্ধনে। গ্রামে বেশির ভাগ মানুষ বাঁশ, শোলা, ছনের ঘরে ও অবস্থাপন্ন গৃহস্থরা টিনের চাল টিন বা বাঁশের চটার বেড়া নির্মিত ঘরে বাস করত। অনেক সময় খড়, আখের পাতা, ধনী হলে ঘরে টিনের ছাউনি দিত। গাছগাছালি ভরা, বাঁশঝাড় পেরিয়ে ছোট্ট উঠোনের একটি বাড়ি। সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়িঘর বানানো হতো। ঘরের দরজা বলতে ঝাঁপ থাকত। ঠেলে ঠেলে লাগানো বন্ধ হতো। যারা একটু অবস্থাসম্পন্ন, তারা ঘরের দরজা হিসেবে কাঠ বা টিন ব্যবহার করত। ছিটকারি বা খিল থাকত দরজায়। অবস্থাসম্পন্ন যারা, তারা ভিত উঁচু করে টিনের ঘর বানাত। রান্নাঘর হতো সব সময় শোলা বা ছনের। রান্নাঘরে থাকত ঢেঁকি। ধান ভানার কাজ হতো এখানেই। ঘরের পাল্লা হতো বাঁশ দিয়ে। বসতঘরের সামনে থাকত বারান্দা। বারান্দার এক কোণে সন্তানের পড়ার ঘর। ছোট জানালা, পত্রিকার কাগজ দিয়ে নায়ক-নায়িকার ছবি লাগিয়ে সাজাত ছাত্রছাত্রী তাদের পড়ার ঘর। একটু দূরে গোয়ালঘর। যাদের হাল ছিল, গরু বা গাভীর যত্নে খড়ের পুঞ্জি, পানি খাওয়ানোর জন্য গামলা থাকত উঠানের পাশেই। বাঁশের বেড় বানিয়ে গরু বেঁধে রাখা হতো। ঘাস, খড়, এখানে দেওয়া হতো গরুকে। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে লজিং মাস্টার রাখতেন নিজ সন্তানদের সকাল-বিকেল পড়ানোর জন্য। লজিং মাস্টার থাকতেন কাছারি ঘরে। অন্দরমহলে শোয়ারঘর, রান্নাঘর, লাকড়িঘর, গোয়ালঘর নিয়ে গ্রামের বাড়ির পরিধি। বাড়ির পেছনেই বড় জঙ্গল। কামরাঙা, জলপাই, আবন্যা গাছ, লাকড়ির গাছ, জাম্বুরা, ঝাউগাছ দাঁড়িয়ে থাকত। বাঁশ, বেত, ছনবনের সামান্য উপকরণ দিয়ে বানানো হতো গ্রামীণ বাড়িঘর। ঘরের সামনে কবুতর পোষতে থাকত কাঠের কূপ। সারা দিন বাকবাকুম, ওড়াউড়ি করত কবুতর দম্পতি। গ্রামে যারা ঘর বান্ধার গাছ করে দিত, তাদের বলা হতো ‘ছাপরবন’। ঘর বানানো, মেরামত, প্রভৃতি কাজে ছাপর বনের ডাক পড়ত। পানের বরজের কাজ তারাই করত। নিজেরা গরিব থাকলেও অন্যের বাড়িঘর মেরামত করে, যা পেত তা দিয়েই চলত সংসার চাকা। ছাপরবনের খুব কদর ছিল গ্রামে। সবাই এই কাজ পারত না বিধায় ছাপর বনের সারা বছর কাজ থাকত। গ্রামীণ ঘরবাড়ি বানানোর উপকরণ ছিল বাঁশ, বেত, ছন, বন, খড়, পাটশোলা, তালপাতা, তালগাছ, সুপারিগাছের খোল, আখের পাতা ইত্যাদি। অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়িতে কাছারি ঘর বা বাইর ঘর, বৈঠকখানা, গোয়ালঘর, ঢেঁকিঘর, আটচালা, চৌহারি ঘর থাকত। কিন্তু দরিদ্র মানুষ একটা ছনের নিচু ঘর বানাত, যেখানে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকতে হতো। পাশেই থাকত বেড়া ছাড়া শুধু ছনের বা আখপাতার ছাউনি দেওয়া খোলাঘর। মাটিতে বানানো থাকত রান্নার চুলা। এটাই ছিল রান্নাঘর। বাড়ির পোষা কুকুর চুলার পাড়ে ঘুমাত। আর চুলা ভেঙে দিত। ফলে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কৃষক গিন্নি চুলা মেরামত ও লেপে নিতেন, আর বেচারা কুকুরকে ঠেঙা দিয়ে দৌড়ানো দিতেন। শোলার বেড়া বা সুপারিগাছের খোল ঝুলিয়ে বাড়ির বাউন্ডারির কাজ করত। বছরী কাজের লোক থাকত কাছারি ঘরে খড় বিছানো বিছানায়। বর্ষায় একটানা বৃষ্টি থাকত বিধায় দরিদ্র মানুষের ছনের ঘরে পানি পড়ত। খড় বা ছনের চালা বর্ষার দিন অতিবৃষ্টিতে পচে যেত। তখন গ্রামের বাড়িতে টয়লেট ছিল না। মাটি গর্ত করে ওপরে কাঠ বাঁশ বিছিয়ে সুপারিগাছের খোল বা কলাগাছের ডাগ্গোয়া ঝুলিয়ে বেড়া দিয়ে টয়লেট বানানো হতো। টয়লেটকে গ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘টাটকি’ বলা হতো। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার মহেশ গল্পে গফুর ও তার বাড়ির বর্ণনায় গ্রামীণ অভাবী জীবনের চিত্র বিশদভাবে উঠে এসেছে। চৈত্র মাস এলেই অভাব দেখা দিত গ্রামে। এটাকে বলা হতো, ‘চৈত মাইয়া টানা’। সে সময় গ্রামের মানুষের অনেকের নিজস্ব ঘর বাড়ি ছিল না। পরিচিত কারোর বাড়ির কাছারি, কেউবা গোয়ালঘরে থাকত। ছাপরবন লোকদের নিজেদের ঘরটাই মেরামত করতে পারত না টাকাপয়সার অভাবে। আস্তে আস্তে সময় পাল্টে যেতে থাকে। গ্রামের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, লেখাপড়ার প্রতি টান ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শিখে যায়। বাঁশের পালা, ছন শোলার বেড়া, আখপাতার ছাউনির বদলে চলে আসে টিন, ইট সিমেন্টের বিল্ডিং বাড়ি। আধুনিক জীবন এসে শান্তির জানালায় যতই উঁকি দিয়ে যাক, বাস্তব জীবনে খাপ খাওয়াতে, বেঁচে থাকায় হোঁচট খায় মানুষ। বাড়ির সামনে পুকুরে সাঁতার কাটায় ব্যস্ত ছোট ছেলেমেয়ের দল। কৃষক গরু নামায় পুকুরে গোসল করাতে। পানিতে হঠাৎ নাড়া পেয়ে ছোটাছুটি শুরু মাছের দল। বরইগাছে ঢিল দিলে সব বড়ই পুকুরের পানিতে পড়া ছেলেবেলার আরেক কষ্টের নাম। সন্ধ্যা হতেই পুকুর বা জলাশয়ের ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আসা জোনাকি মেয়ের দল। ঝিঁঝিঁপোকার চিৎকার, একটু বৃষ্টি হলেই নামা জমিতে জমে থাকা পানিতে মেকো মেকো করে ব্যাঙ ডেকে যেত। সকাল নাই দুপুর নাই, যেকোনো সময় বাড়ির দেওরির কাছে হাঁক দিত ভিখারিরা- ‘দিবাইন গো মা, দুইডা ভিক্ষা’। কখনো কখনো দূরের পথিক ক্লান্ত হয়ে কাছে এসে চুপি চুপি বলত, ‘না খেয়ে আছি, দুটো খেতে দিন মা।’ এখন সারা গ্রাম হেঁটে এলেও আগের বাড়িঘর, এর সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সভ্যতা এখন বিল্ডিং বাড়িঘর এনে দিয়েছে কিন্তু সেই সহযোগী মন হারিয়ে গেছে। পাট জাগ দেওয়ার পাগার বা জলাশয়, পুকুর নেই আগের মতো। ঘরের সামনে ডালিমগাছে বানানো টুনটুনির বাসা, পুকুর পাড়ে থাকা তালগাছে বাবুইয়ের বাসা, লিছুগাছের কোঠরে শালিকের নীলচে ডিম এখনকার প্রজন্মের দেখার সময় কই? ওরা এখন হাতের মুঠোয় বিশ্ব পেয়েছে ইন্টারনেটের বদৌলতে। গ্রামের পুরোনো বাড়িঘর এখন শুধুই স্মৃতি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close