কাজল রশীদ শাহীন

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বই মেলা না, বইমেলা হোক

বইমেলা কিশুধুই বই মেলায় রূপ নিচ্ছে? এ নিয়ে তর্ক, আলাপ ও প্রশ্ন করার সময় এসেছে, জরুরি হয়ে পড়েছে। মেলা শব্দের অর্থ একাধিক। সাধারণত এবং সর্বজনের কাছে গ্রাহ্য ও পরিচিত রূপ হলো এরউৎসব অর্থ। যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক ও বাণিজ্যিক কারণে অনেক মানুষ মিলিত হয়, তাকেই মেলা বলে। ‘মেলা’ বলতে উন্মীলনও বোঝায়। যেমন চোখ মেলো, অর্থাৎ তাকাও-উন্মীলন করো। ‘মেলা’ বলতে অনেক বা বেশিও বোঝায়। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, মেলা শব্দের মধ্যে তিনটি অর্থ-ই রয়েছে, থাকাটাও জরুরি। কোনো কারণে যদি তিনটার পরিপূরক না হয়ে একদিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলেই ‘মেলা’ আর মেলা-উৎসব হয়ে উঠে না। অমর একুশে বইমেলা কি তার ‘ত্রয়ী অর্থগুণ’ হারাচ্ছে। আমাদের বইমেলারলক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, সে উৎসবের প্রতিনিধিত্ব করবে, উৎসব অর্থে যে মেলা বোঝায়- তার স্বরূপে প্রকাশিত হবে। কিন্তু ২০২৪-এ এসে দেখা যাচ্ছে, বইমেলা সেই চরিত্র হারিয়ে বই মেলায়পরিণত হয়েছে। এ কারণে আমাদের ভাবার সময় এসেছে বইমেলার মৌল চরিত্র নিয়ে। যে চরিত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত রয়েছে আমাদের একুশের চেতনা, মাতৃভাষার ন্যায়সংগত-ন্যায্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠার হিরণ¥য় অধ্যায়, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালির আবেগ ও আত্মসম্মানবোধের ঐতিহাসিক পরম্পরা- আদতে সেসব কতটুকু বজায় আছে। বইমেলাকে আমরা সত্যিকারার্থে বইমেলায় পরিণত করব, নাকি বইমেলার দিকে ঠেলে দেব- সেটা নিয়ে জোরদার আলাপ ও তর্কচর্চা জরুরি হয়ে পড়েছে।বইমেলা যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে কি? যেভাবে তার মান-মর্যাদা,আভিজাত্য ও কৌলিন্য ক্রমেই তলানির দিকে যাচ্ছে। আমরা কি সেসব নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে কেবলই দেখব, প্রতিকার বা সংশোধনের জন্য কিছুই করব না? বইমেলার জন্ম হয়েছে একুশের চেতনা থেকে। তার নামেই রয়েছে অমর একুশের গৌরবজনক উপস্থিতি। তাহলে আমরা কেন তার চরিত্রের অবনমন নিয়ে ভাবিত হব না, উদ্বেগ প্রকাশ প্রকাশ করব না?

বইমেলায় প্রতি বছর কমপক্ষে তিন থেকে চার হাজার বই প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমির কাছে পুরো তালিকা না থাকায়, প্রকৃত সংখ্যাটা অজানা। কারো কারো মতে সংখ্যাটা তার থেকেও বেশি- পাঁচ হাজারের কাছাকাছি, তবে তিনহাজারের কম নয়। প্রশ্ন হলো, আমাদের তিনহাজার লেখক কি আছেন? একটা মেলাকে ঘিরে তিন হাজার বই উৎপাদন করার মতো ‘প্রকাশনা ইন্ডাস্ট্রি’ কি আমরা দাঁড় করাতে পেরেছি? আমাদের কয়জন লেখক আছেন, যিনি বা যারা পেশাদার। শুধু লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করেন কয়জন- একজনও নেই। দু-একজনের নাম শোনা গেলেও আতশীকাচ দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়। যাদের নাম শোনা যায়, তারা অন্যবিধ সুযোগ-সুবিধা ও সহযোগিতার ওপর দাঁড়িয়েই পেশাদার লেখকের তকমা সাঁটিয়ে রেখেছেন।

ঝাঁকের কইয়ের মতো লেখকের ভিড়ে প্রকৃত লেখকের সংখ্যা যে কম, বলাবাহুল্য। এ কারণে ভালো বইয়ের সংখ্যাও কম। বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে সব থেকে বেশি প্রকাশিত হয় কবিতার বই। তার পরে রয়েছে গল্প-উপন্যাসের বই-কথা সাহিত্য। মেলা জুড়ে থাকে শিশুতোষ বইয়ের আধিক্য। ইদানীং যুক্ত হয়েছে মোটিভেশনাল স্পিকারদের বই। তাদের বাজার বেশ রমরমা। অনেক আগে ডেল কার্নেগির সরব উপস্থিতি ছিল। সে সময় পেরিয়েছে অনেক আগেই। ইতি টানার কথা ছিল ওই ধরনের পঠন-পাঠনে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু ডেল কার্নেগি আবার সদম্ভে ফিরে এসেছে- এদের হাত ধরে-নানা স্বরূপে। ডেল কার্নেগির এই ফিরে আসায় কি প্রতীয়মান হয়- বৌদ্ধিকতায় আমাদের যতটা এগোনের কথা ছিল, ততটা হয়নি।

বইমেলায় সব থেকে গৌণ অবস্থানে রয়েছে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের বই। যতদিন যাচ্ছে, এই অবস্থার অবনমন হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা থেকে এই ধারাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেসব- এতবেশি গোঁজামিলে ভরা যে, তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো সুযোগ কম।

এক্ষণে শরণ নিতে হয়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কমলাকান্তের দপ্তরের। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন- সাহিত্যের বাজার দেখিলাম। দেখিলাম, বাল্মীকি প্রভৃতি ঋষিগণ অমৃতফল বেচিতেছেন। বুঝিলাম, ইহা সংস্কৃত সাহিত্য। দেখিলাম, আর কতকগুলে মনুষ্য লিচু,পিচ, পেয়ারা, আনারস, আঙুর প্রভৃতি সুস্বাদু ফল বিক্রয় করিতেছেন- বুঝিলাম এই পাশ্চাত্য সাহিত্য। আর একখানি দোকান দেখিলাম- অসংখ্য শিশু এবং অবলাগণ তাহাতে ক্রয় করিতেছে- ভিড়ের জন্য তন্মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিলাম না- জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এ কীসের দোকান?’ বালকরা বলিল, ‘বাঙ্গালা সাহিত্য’। বিক্রেয় পদার্থ দেখিবার বাসনা হইল। দেখিলাম- খবরের কাগজে জড়ানো কতকগুলি অপক্ব কদলী।’ (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কমলাকান্তের দপ্তর, বঙ্কিম রচনাবলি, ২য় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ সং, পৃ.৯০)।

বইমেলার নামে আমরা কি সত্যিই ‘খবরের কাগজে জড়ানো কতগুলি অপক্ব কদলী’র বিকিকিনি করিতেছি? এই প্রশ্ন ওঠার বিকল্প নেই। প্রশ্ন উঠলেই সমাধানের চেষ্টা করা হবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের এক বইমেলাতেই তিন হাজার বইয়ের লেখক মিলছে ঠিকই, কিন্তু প্রশ্নকরার মতো একজন মানুষও মিলছে না।

মেলার চরিত্রের দিক থেকে বইমেলা রয়েছে অনন্য এক জায়গায়। বেশির ভাগ মেলার একটা ধর্মীয় আবহ থেকে। কোনো কোনো মেলা তো ধর্মীয় চেতনারই সম্প্রসারণ ও সম্প্রচার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে অমর একুশে বইমেলা ব্যতিক্রম ও অনন্য। পৃথিবীতেই সম্ভবত এরকম নজির দ্বিতীয়টি রয়েছে কিনা, জানা নেই। আমাদের বইমেলার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সর্বজনবিদিত। এর সঙ্গে যুক্ত আছে এক মাসের সময় পরিসর। সবচেয়ে বড় কথা, এই মেলার চেতনায় রয়েছে একুশের আবেদন ও নিবেদনের সব আবেগ-অনুভূতি, শ্রদ্ধা ও প্রেম।

আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় স্বীকৃত ও সম্মানিত। এই প্রাপ্তি আমাদের জন্য পরম গৌরবের। এখন আমরা যদি একুশের চেতনার যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটাতে না পারি। বইমেলাকে প্রকৃতার্থে বইমেলায় পরিণত করা সম্ভব না হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা হবে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা।

যেকোনো মেলারই একটা বারোয়ারি দিক থাকে। কিন্তু সেটা যেন মূলধারা না হয়ে ওঠে, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। খেতে আগাছা থাকে, কিন্তু আগাছাই যেন খেতের পরিচয় না হয়ে ওঠে। বইমেলার ক্ষেত্রে এসব নিয়ে আমরা কি ভাবিত হচ্ছি, নাকি শুধুই চেয়ে চেয়ে দেখছি।

মনে রাখতে হবে,বইমেলার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো,একটা বইপড়ুয়া জাতি-গোষ্ঠী তৈরি করা। একুশের চেতনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। বই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো। এজন্য প্রয়োজন ভালো বই, মানসম্পন্ন বই। যে বই চোখ খুলে দেয়। যে বই প্রশ্ন করতে শেখায়, প্রশ্নের জন্য আগ্রহী করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বনফুলকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন- ‘গল্প-উপন্যাস না পড়িলেও চলিবে, কিন্তু প্রবন্ধ পড়িতেই হইবে।’ বইমেলার আয়োজক যারা, তাদের কী এসব নিয়ে কোনো ভাবান্তর আছে? নাকি বইমেলা- বই মেলা হয়ে উঠলেও তাদের কিছুই বলা বা করার নেই?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close