পার্থ সারথি দাস

  ০১ ডিসেম্বর, ২০২৩

বই পরিচিতি

যুদ্ধাপরাধীর একটি যৌক্তিক তালিকা

নানা ত্রুটি-বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ হানাদার-সহযোগী অপরাধীদের বিচার করার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরের পরাজিত ও হাল আমলের ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তান তাদের পক্ষ নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করায় খোদ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটিও সামনে চলে আসে। তখন খোঁজাখুঁজি শুরু হয় স্বাধীনতার পর প্রণীত পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের তালিকার। ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত একটি সংগঠনকে এ বিষয়ে বেশি সরব দেখা গেল। তারা ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি তুলল জোরালোভাবে। কিন্তু বহুল আলোচিত সেই ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির তালিকা পাওয়া গেল না কোথাও। না পাওয়ারই কথা! অবশেষে ২০০ জনের একটি তালিকা হাজির করা হলো সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। তালিকা তুলে ধরা হলেও জানানো হয়নি তালিকাটি কোথা থেকে পাওয়া গেল।

এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক ও গবেষক আজাদুর রহমান চন্দনের ভাষ্য, ‘গবেষণার কাজ করতে গিয়ে এর আগেও অনেকেই খোঁজ করেছেন ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির তালিকার। কিন্তু হদিস মেলেনি। একপর্যায়ে ১৯৯৯ গালে ব্রাসেলসপ্রবাসী গবেষক ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন ২০০ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেন নিজের গবেষণার ফল দাবি করে। সেই তালিকা আর কয়েক বছর আগে মন্ত্রীর হাজির করা তালিকার মধ্যে কোনো অমিল নেই। এরই মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও একটি তালিকা পাওয়া যাচ্ছিল ২০০ জনেরই, যার সঙ্গে আহমেদ জিয়াউদ্দিনের তালিকা পুরোপুরি মিলে যায়। যদিও স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী সময়ে ২০০ জনের কোনো তালিকা করার তথ্য মেলে না দলিলপত্রে।’ চন্দন এসব কথা লিখেছেন ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত তার ‘১৯৭১ : যুদ্ধাপরাধীর তালিকা সন্ধানে’ শীর্ষক গ্রন্থে।

১৯৭২ সালের মার্চে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বইটিতে বলা হয়েছে, ‘একাত্তরে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রথমে জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলীসহ ১ হাজার ১০০ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার বিচার করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা ভারতের হাতে থাকায় সে দেশের দিক থেকে তাগিদ ছিল দ্রুত অপরাধীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করার। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবন্দিদের বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে বলেও আশ্বাস দিয়েছিল ভারত। সঙ্গত কারণেই এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সংখ্যাটি অর্ধেকে নেমে আসে। রয়টার্সের বরাত দিয়ে সে বছরের ১৫ জুন পাকিস্তান টাইমসের এক খবরে বলা হয়, গণহত্যার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচার করার লক্ষ্যে জেনারেল নিয়াজিসহ ১৫০ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছে ভারত। ১৯৭৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি হিন্দুস্তান টাইমসে একটি সংবাদ ছাপা হয় ঢাকা থেকে পিটিআইয়ের পাঠানো। তাতে বলা হয়, গণহত্যার অভিযোগে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানসহ দেশটির শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার করবে। এক সরকারি মুখপাত্রের বরাত দিয়ে ওই খবরে আরো বলা হয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে পাঁচ শতাধিক যুদ্ধাপরাধীর একটি তালিকাও তৈরি করেছে।’ ভারতীয় কূটনীতিক প্রয়াত জে এন দীক্ষিত তার ‘লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে চন্দন লিখেছেন, ‘৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির মধ্যে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত পাকিস্তানির সংখ্যা বাংলাদেশ সরকার ৪০০ থেকে ১৯৭২ সালের জুলাই নাগাদ কমিয়ে আনে ১৯৫-এ। সংখ্যাটির উল্লেখ আছে আরো কিছু দলিলপত্রে।’ চন্দনের বইয়ের পরিশিষ্টে সে রকম দলিলের ছবিও দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার বাস্তবতা তুলে ধরে চন্দন লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার মতো অবস্থা এ মুহূর্তে আছে কী নেই, সে নিয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে। এটা ঠিক যে, এ মুহূর্তে দেশে চালু থাকা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব। অবশ্য বিচার করা গেলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। তবে রায় কার্যকর করা সম্ভব না হলেও বিচার শুরু হলে অভিযুক্ত অপরাধীদের পাকিস্তানের বাইরে চলাফেরা অনেক সীমিত হয়ে যাবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ভিসা দিতে রাজি হবে না অনেক দেশই। এ ছাড়া বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রায় কার্যকর করার মতো পরিস্থিতি কোনো দিনই আসবে না তা-ও নয়। কাজেই বর্তমানে যুদ্ধবন্দিদের পুরোনো তালিকা নিয়ে হা-পিত্যেশ না করে নতুন করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করাটাই হবে যুক্তিসংগত। কারণ সেই ১৯৫ জনের তালিকা পাওয়া গেলেও তাদের সবাই তো আর জীবিত নেই। কাজেই বিচার করতে গেলে তখন সংখ্যা আরো কমে আসবে। এ ছাড়া পুরোনো তালিকায় নাটের গুরুদের নাম না থাকাই স্বাভাবিক।’

পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে চন্দন আরো লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যার সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি যাদের ওপর বর্তায় সেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল আবদুল হামিদ খান, “পূর্ব পাকিস্তানের কসাই” নামে কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানদের নাম অন্তত অপরাধীর তালিকায় না রাখাটা সমীচীন হবে না।’

মার্কিন গবেষক রবার্ট পেইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে শীর্ষস্থানীয় পাঁচ জেনারেলের কনফারেন্সে। পাঁচ জেনারেল একটি টেবিল ঘিরে বসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার ছক কষতে। ওই পাঁচ জেনারেল হলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জেনারেল পীরজাদা, আর্মির কোর কমান্ডার জেনারেল টিক্কা খান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল চেয়ারম্যান জেনারেল উমর খান ও গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল আকবর খান।’ (Robert Payne, Massacre, The Macmillan Company, New York, Page 13)

আলোচ্য গ্রন্থে ঢাকায় তখনকার ৫৭ ব্রিগেডের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার অভিযানে নেতৃত্ব দানকারী লে. কর্নেল জেড এ খানসহ ৩২১ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার পরিচয়সহ অপরাধের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে দালিলিক প্রমাণসহ। সেই সঙ্গে একাত্তরে যেসব বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যেও ২৪ জনের নামণ্ডপরিচয় এবং অপরাধের তথ্য দেওয়া হয়েছে।

বইয়ের ফুটনোটেই ১৪৭টি দালিলিক সূত্রের উল্লেখ আছে। এর বাইরে লেখার ভেতরেও অনেক সূত্র দেওয়া হয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন বদরুল হায়দার। ১৯২ পৃষ্ঠার বইটির দাম ৪০০ টাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close