আলমগীর খোরশেদ

  ০১ ডিসেম্বর, ২০২৩

গ্রামীণ ঐতিহ্য

তুফাতি বা চড়ুইভাতি

চড়ুইভাতি শব্দটা শুনলেই বুকের ভেতর খামচে ধরে ছোটবেলার স্মৃতি। অঘ্রাণে ধানকাটা শেষ হলে খালি জমিতে আয়োজন করা হতো চড়ুইভাতি, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় তুফাতি। চড়ুই+ভাত, মানে চড়ুই পাখির মতো অল্প ভাত খাওয়া হয় যে আয়োজনে, সেটাই হলো চড়ুইভাতি। গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা যাদের, তাদের কাছে চড়ুইভাতি যেন এক স্মৃতিময় গদ্য। ছোটবেলার বন্ধুদের মুখ ভেসে উঠে মনের ক্যানভাসে। গ্রামে থেকে বড় হয়েছে কিন্তু চড়ুইভাতি করেনি, এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া যাবে না। যখন অনেক ছোট বয়স তখন ঘরের উঠানে মাটির তৈরি ডেগ-ডেগচি, কড়াইয়ে মিছামিছি রান্না হতো। মাটি গর্ত করে ছোট চুলা বানিয়ে ভাত হিসেবে বালু, তরকারি হিসেবে গাছের ফুল, পাতা, মাংস হিসেবে কলাগাছের ডাগ্গোয়া কুচি কুচি করে কেটে, তাতে ইটের গুঁড়ো ও হালকা পানি দেওয়া হতো। কলাগাছের ডাগ্গোয়ার বাকল ছিলা থাকত বিধায় এর রং ইটের রং হয়ে যেত। যাকে মাংসের তরকারি ধরা হতো। এ রান্নাবান্নাকে বলা হতো টুলিমুচির রান্না। কাঁঠালপাতায় বালির খাবার তরকারিসহ নিয়ে মুখে ‘কলো কলো কলো, ডবো ডবো ডবো’ খাওয়ার শব্দ করে ছিটিয়ে ফেলে দিত, এটাই খাওয়া।

পাশেই চারকোণে চারটি বাঁশের কঞ্চি খুঁটি হিসেবে মাটিতে কোপে তিন পাশে খড় ও শোলার বেড়া দিয়ে খেলার ঘর বানাত গাঁয়ের শিশুরা, কলাপাতা দিয়ে এ ঘরের ছাউনি হতো। ছোট্ট ঘরটাকে দোকানঘর বানানো হতো। কাঁঠালপাতা ও সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে টাকা বানিয়ে চাল হিসেবে বালু, মাছ হিসেবে নাকফুল, তরকারি হিসেবে হেলেঞ্চা ও কলমি শাক ব্যবহার হতো। খেলা শেষ হলে সবাই মিলে পাটশোলা ও কলাপাতার ঘরটি ভেঙে ফেলত। পড়ার ক্ষতি হবে, তাই অভিভাবকরা বকা দিতেন।

আর একটু বড় হলে চড়ুইভাতির ধারণাটা বাস্তবে চলে আসত। বাড়ির সামনে পুকুর, তাতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে তুফাতি খেলার চিন্তাটা মাথায় আসত। বাড়ির ছোট-বড় ভাইবোন, পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে পরামর্শ, চাল, ডাল, মাছ, আলু ও শিম- সবাই মিলে যার যার ঘর থেকে নিয়ে আসবে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুল বন্ধ। পড়ার জন্য লজিং মাস্টার কিংবা বাবা, ভাইয়ের বকুনি নেই। তখনি তুফাতি বা চড়ুইভাতি করার মোক্ষম সময়। সিনিয়র ভাই বোনদের সঙ্গে আলাপ করে সহযোগিতার পক্ষ পাকাপোক্ত করে তুফাতি খেলার আয়োজনে নেমে পড়ত ছোটরা। বন্ধুদের নিয়ে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি হেঁটে চাল, ডাল, কাঁচামরিচ, মসলা, পেঁয়াজ, রসুন, খেতের আলু, পোষা মুরগি বা হাঁসের ডিম, যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী দিত। গৃহস্থ বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে শিশুরা বলত, ‘দিবাইন গো চাউল, দিবাইন গো ডাউল, বাইত কেলা আছুইন।’ প্রয়োজনীয় ডেক-ডেকচি, কড়াই, কলসি, জগ, বাটি আনা হতো আশপাশের বন্ধুদের বাড়ি থেকে। লাকড়ি হিসেবে পাটশোলা, বাঁশঝাড়ে গিয়ে শুকনো কঞ্চি, জঙ্গল থেকে গাছের শুকনা ডাল ভেঙে আনা হতো। পুকুর থেকে বড়শি দিয়ে ধরা পুঁটি, রুইকড়া মাছ কেটে দিতেন আপারা। তারা পাশে থেকে বলে দিতেন কোনটার পর কোনটা করতে হবে। মাঠে তখন ধান কাটা শেষ। পাশেই সরিষাখেত দূর থেকে দেখে মনে হতো- হলুদ শাড়িতে সেজেছে পল্লীবালা।

বাড়ির সামনে ধানকেটে নেওয়া জমিতে চুলা বানাতে হতো। কন্তি, কোদাল বা শাবল দিয়ে মাটিতে গর্ত করে তার পাশে ইট দিয়ে তিনকোনা করে বিছিয়ে চুলা বানানো হতো। চুলায় আগুন ধরানোর জন্য পাটশোলায় সামান্য কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়ে কাছের বাড়ির রান্নাঘর থেকে আগুন ধরিয়ে আনা হতো। বাতাসে বারবার নিভে যেত আগুন। সে আরেক বিড়ম্বনা। বাবার কাছে ম্যাচ থাকে, কারোর সাহস নেই বাবার কাছে ম্যাচ চেয়ে আনবে। শুনলেই বকা দেবেন বাবা। আগুন নিভে যাবে তাই একটু পরপর ফুঁ দিতে হতো চুলায়। আগুন চাঙা রাখার জন্য। যে এ কাজটি করত, ধোঁয়ায় তার চোখে পানি চলে আসত। গাছের ডাল বা কাঠের টুকরো লাকড়িতে একবার আগুন ধরে গেলে তখন সহজে নিভত না। লাইন ধরে রান্নার আয়োজনে লেগে যেত সবাই। ছোটরা তাদের মায়ের ট্রাংকে গুছিয়ে রাখা জামাটা চেয়ে আনত বারবার মায়ের কাছে বায়না ধরে। পায়ে আলতার বদলে পুঁইশাকের বিচি ঘষে আলতা রঙে রাঙিয়ে নিত মেয়েরা। লাল কাগজ পানিতে হালকা ভিজিয়ে ঠোঁটে ঘষে লিপস্টিকের কাজ করত। কলার ডাগ্গোয়া বা চামচে সরিষার তেল লাগিয়ে তা কুপি বাতির আগুনের আঁচে ধরে রাখলে যে কালো জিনিসটা সরিষা তেলের সঙ্গে মিশত, সেটাই মেয়েরা চোখে লাগাত কাজল হিসেবে। নারকেলপাতা কেটে এনে ঘড়ি, চশমা, আংটি বানিয়ে পরে বসে থাকত ছোটরা। পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে চোখের পানি চলে আসত, যারা পেঁয়াজ কাটত। কাঁচামরিচ লম্বা করে কাটতে হবে বলে দিচ্ছে বড়রা। সেদ্ধ করা ডিম চিলা বা খোসা ছাড়াতে সবাই রাজি। হুমড়ি খেয়ে পড়ত। যদি ডিমের ছোট কোনো ভাঙা টুকরো খোসায় মিশে থাকে, তা খেতে পারবে। কেউ রসুনের খোসা ছড়িয়ে দিত, সেদ্ধ করা আলুর খোসা ছড়াত কেউ।

আপারা বসতেন বড় ডেকচিতে ভাত বসানোতে। একটু বুঝে যারা, তারা রান্নায় সহযোগিতা করত।

রান্নাবান্না শেষ করে খেতে গিয়ে দেখা গেল ভুলে তরকারিতে লবণই দেওয়া হয়নি। ধানখেতে খড় বিছিয়ে বসে কলাপাতায় খাওয়া হতো তুফাতি বা চড়ুইভাতি। লাইন ধরে সবাই বসলে সামনে কলাপাতা কেটে এনে প্লেট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। হাত ধোয়ে সামান্য পানি মাটিতে বিছিয়ে রাখা কলাপাতায় ছিটিয়ে দিয়ে হাতে কলাপাতাটা মুছে দিত। কলাপাতায় ময়লা, পোকামাকড় লুকিয়ে বসে থাকত। ছোটবেলায় কলাপাতায় খিচুড়ি বা ভাত খেতে গিয়ে প্রায়ই পোকামাকড়ই পেটে চলে যেত। সারাক্ষণ চিন্তা থাকত, পেটে চলে যাওয়া পোকা কোনো ক্ষতি করবে না তো? কারোর ঘরে হয়তো মা শিকেতে তুলে রেখেছেন আচারের বৈয়াম। চড়ুইভাতি খেয়ে কেউ বায়না ধরল আচার খাবে। মায়ের ঘর থেকে আচারের বৈয়াম চুরি করে আনা যুদ্ধ জয়ের মতোই কঠিন ছিল। ধানখেতে বসে কলাপাতায় খাওয়ার আনন্দ যে পায়নি, সে গ্রামের মজাই পায়নি। ছোট্ট বাচ্চারা রান্না করার জায়গাটা ঘিরে বসে থাকত। চুলা নিভে ধোঁয়া বেরোলে চোখ জ্বালা করা সত্ত্বেও বসে থাকা বাচ্চাদের কেউ উঠত না তার জায়গা থেকে। যদি জায়গাটা দখল হয়ে যায়, সেই ভয়ে।

তুফাতি বা চড়ুইভাতি খেলার দিন কুয়াশা আচ্ছাদিত সুন্দর সকাল। নীল আকাশে মেঘের ওড়াউড়ি যেন প্যাঁজা তুলোর মতো। ঝিলমিলে রোদ চারপাশে সোনা ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। গ্রামের সঙ্গে তুফাতি বা চড়ুইভাতির একটি আত্মিক যোগ ছিল। বাঙালিয়ানায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে হাজারো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। চড়ুইভাতি তারই একটি অংশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close