আলমগীর খোরশেদ
গ্রামীণ ঐতিহ্য
গোয়ালঘর
আবহমান বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতি নিয়ে হাজার বছর ধরে চলে আসছে সহজ-সরল গ্রামীণ জীবন। শিল্পীর তুলিতে আঁকা, ছায়াঢাকা, পাখি ওড়া শান্ত গ্রামে কয়েকটা ঘর নিয়ে বাড়ি, কয়েকটা বাড়ি নিয়ে পাড়া, এভাবে পাড়ার সমন্বয়ে হয় গ্রাম। সুখে-দুঃখে একে অন্যের সঙ্গে আত্মীয়ের মতো বাস করে গ্রামের মানুষ। গৃহস্থের যার যত বেশি হাল থাকত, তার সম্মান হতো তত বেশি। মাটির ভিত, পাটশোলা বা বাঁশের ফলা দিয়ে তৈরি বেড়া ও ছনের ছাউনিতে গোয়ালঘর বানানো হতো গরুর জন্য। মানে গবাদি পশু থাকা, বিশ্রামের জন্য যে ঘর বানানো হতো, সে ঘরকে বলা হতো গোয়ালঘর। গোয়ালঘরে বেড়া ঘেঁষে ভেতরের দিকে লম্বা বাঁশের তৈরি বেড়া থাকত, যাতে গরুর খাবার খড়, ঘাস দেওয়া হতো। তিন চার হাত পরপর দুই থেকে তিন ফুট উঁচু বাঁশের খুঁটি পুঁতে রাখা হতো। এই খুঁটিতে গরুর রশি বাঁধা হতো। হালে থাকে দুটি বলদ গরু। এভাবে তিনটা হাল মানে ছয়টি গরু। দুধ খাওয়ার জন্য অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে একটা বা দুটো গাভি থাকত। সঙ্গে গাভীর বাছুর। সন্ধ্যা হলেই খড়ের পুঞ্জি থেকে গরুর রশি খুলে গোয়ালঘরে রাখার জন্য আনা হতো। তার আগে গোয়ালঘরে বাঁশের তৈরি বেড়ে খড় বা ঘাস দেওয়া হতো। মশার কামড় থেকে গরুকে রক্ষার জন্য সন্ধ্যায় গোয়ালঘরের দরজার মুখে ধানের তোষ জড়ো করে রেখে তাতে আগুন দিয়ে ধোঁয়া দেওয়া হতো। শীত থেকে গরুকে রক্ষার জন্য পাটের চট কেটে গরুর পিঠে জড়িয়ে পেটের দিকে বেঁধে দেওয়া হতো।
গ্রামের মাসিক বা বছরী মুনি, দৈনিক কামলা থেকে শুরু করে বেশির ভাগ গৃহস্থ হুক্কা বা তামাক খেতেন। হুক্কাতে আগুন দেওয়ার জন্য টিক্কা বানাতো গৃহস্থ গিন্নি। লাকড়ি পোড়ানোর ছাই ঠাণ্ডা হলে তা গাইলে রেখে গুঁড়ো পাউডার করে তা পানিতে গুলে গুড়ের পাড়া বানানোর মতো টিক্কা বানানো হতো। গোয়ালঘরের পাটশোলার বেড়ায়, বাঁশের পালায় লাউয়ার ভেতর টিক্কা ঝুলিয়ে রাখা হতো। ‘লাউয়া’ হলো বড় সবুজ লাউ পরিপক্ব করে তাতে গোল করে মুখ কেটে ভেতরের বীজ ও অন্য অংশ ফেলে দিলে যে লাউয়ের খোলস পাওয়া যেত, সেটাই হলো লাউয়া। হালের লাঙল, জোয়াল, আঁচড়া, মই ইত্যাদি গোয়ালঘরের বাঁশের আঁড়ার ওপর বিছিয়ে রাখা হতো।
বিকেল হলে গাভি নিয়ে বাড়ির কর্তা গৃহস্থ রাস্তার পাশে, আখখেতের পাশে উঁচু হয়ে বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাস গাভিকে খেতে দিত। সন্ধ্যা পর্যন্ত গাভিকে ঘাস খাওয়ানো হতো। বছরী মুনি বনডাটা মানে দেখতে ডাঁটার মতো গায়ে কাঁটা যুক্ত, গ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যাকে কুইরা কাঁটা বলে, তা কেটে এনে, কলার মোচা কুচিকুচি করে কেটে সঙ্গে চালের খুদ মিশিয়ে বড় কড়াইয়ে সেদ্ধ দেওয়া হতো। ঠান্ডা হয়ে এলে তাতে লালি, লবণ মিশিয়ে গাভিকে খেতে দেওয়া হতো। এটাকে আঞ্চলিক ভাষায় গাইয়ের জাউ বলা হয়। জাউ খেয়ে গাইয়ের দুধ বেড়ে যেত। দুগ্ধবতী গাভি ও হালের বলদ গৃহস্থের লক্ষ্মী হিসেবে গণ্য হতো। গাই দোহনের জন্য সন্ধ্যা থেকেই বাছুরকে গাভি থেকে আলাদা করে বেঁধে রাখা হতো। সকাল থেকেই বাছুরটি চিৎকার করত মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। দুধ দোহনের কাজটি সবাই পারত না। গাভির পায়ের কাছে বসে দুই হাঁটু দিয়ে মাটির তৈরি পায়লা বা দোনা চেপে ধরে রেখে দুহাতে গাভির বান টেনে দুধ দোহন করতে হতো। অন্য একজন বাছুরকে জোরে ধরে রাখত।
হিন্দু সম্প্রদায়ের গৃহস্থরা গোয়ালপূজা দিতেন। তারা কৃষিকাজে ব্যবহৃত সব দ্রব্য যেমন- লাঙল, জোয়াল, মাতলা, মই, আঁচড়া, গরুকে তাড়িয়ে নেওয়ার বাঁশের লাঠি বা হলা ইত্যাদিতে সিঁদুরের ফোটা দিতেন। চৈত্রসংক্রান্তির বিশু ও আরবিশুর দিনে জঙ্গল থেকে কাঁটাযুক্ত কুমারী লতা এনে গোয়ালঘরের দরজার চারপাশে পেঁচিয়ে রাখা হতো। একটা বিশ্বাস ছিল, রাতে সাপ এসে গাভির দুধ চুষে খাওয়ার ফলে গাভির স্তনের বোঁটায় ঘা হয়, ফলে দুধ দোহাতে গাভি কষ্ট পায় এবং লাতি মারে। কাঁটাওয়ালা কুমারী লতা দিলে সাপ আসে না। প্রতিদিন সকালে গরু বের করে গোয়ালঘরের গোবর পরিষ্কার করতেন বছরী বা মাসিক মুনি। গোয়ালঘরের পাশেই মাটি গর্ত করে গোবর রাখতেন গৃহস্থরা, যা পরে সার হিসেবে জমিতে দেওয়া হতো। এটাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় গোবরটাল। গোবরটাল বিক্রিও করা যেত। যাদের গরু ছিল না, সেসব কৃষক গোবরটাল কিনে নিতেন জমিতে বিশেষ করে আলু, মরিচ রোপণের আগে মরিচ ও আলুখেতে গোবর দেওয়া হয়।
এখন গ্রামে হাঁটলেও গরু চোখে পড়ে না, ফলে গোয়ালঘরও নেই কারোর। আগে যারা একটু দরিদ্র ছিলেন, তারা অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের গাভির বাছুর বা ছাগলের বাচ্চা এনে পুষতেন। আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে বলা হয় রাহানি, তাও কেউ করেন না এখন। আধুনিক যুগে কৃষক এখন মেশিনে হালচাষ করেন।
"