সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী

  ২৪ নভেম্বর, ২০২৩

গল্প

আকাশ নীলে

হেমন্তের সোনাঝরা রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম পড়েছে। মিষ্টি-মধুর হাওয়া ছুঁয়ে যায় মন। নীল আকাশে পাখি উড়ে বেড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে। রমিজ সেই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাত মুখে তোলে। সঙ্গে দুটো পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ নেয়। আহ্, দারুণ স্বাদ খেতে!

সকালের পান্তাভাত খাওয়া শেষ করে রমিজ মাঠে আসে। মাঠে আমন ধান কাটতে শুরু একমনে। মুখে তার রাঙা হাসি। চোখে সোনালি স্বপ্ন জ্বলজ্বল করছে। সেই স্বপ্ন নিয়ে সারাদিন ধান কাটে আর গান গায়।

বিকেলে ধান কাটা শেষ করে। তারপর মহিষের গাড়িতে করে সেই নিয়ে ঘরে ফিরে আসে রমিজ। উঠোনে ধান নামাতে নামাতে বউকে ডাকে। বউ ঘর থেকে ছুটে আসে। হাতে পানির গ্লাস। রমিজের বউ আগে থেকেই বুঝতে পারে- স্বামীর পানি তৃষ্ণা লাগতে পারে। বউয়ের থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খায় রমিজ।

এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়া শেষ করে দাওয়ায় বসে রমিজ। পকেট থেকে সিগারেট বের করে টানতে থাকে। ততক্ষণে বউ হাতপাখা নিয়ে আসে। বাতাস করতে থাকে। শাড়ির আঁচল দিয়ে স্বামী রমিজের ঘাম মুছে দেয়। রমিজ বউয়ের দিকে চেয়ে রসিক সুরে বলে, ‘এই তো আমার লক্ষ্মী বউ। এমন একটা বউ থাকলে আমার সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।’

রমিজ এই কথা বলে বউকে টেনে কাছে নেয়। লাজুক বউ মুখ লুকিয়ে হাসে। বউয়ের ঠোঁটে রাঙা পান। যেন ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। রমিজের বউকে পাকা আমন ধানের মতোই যেন সুন্দর লাগছিল। মাঠ থেকে ফেরা রমিজ যেন নতুন করে তার বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খায়। ঘরে এমন একটা বউ থাকলে মাঠের ক্লান্তি ভুলতে বেশিক্ষণ লাগে না।

গ্রামের এই নীরব পরিবেশে বেড়ে উঠেছে রমিজ। ছোটবেলা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেছে। তারপর আর হাইস্কুলে পড়া হয়নি। অল্প বয়সে প্রিয় বাবা-মাকে হারিয়ে অকুল সাগরে হাবুডুবু খায় কিশোর রমিজ। পাশের বাড়ির চাচা ও চাচির মায়া-আদর ভাগে জোটে তার। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি দেখাশোনা করেই সময় কাটাতে থাকে সে।

যুবক বয়সে পাশের গ্রামের রোজিনা বিবির সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসে রমিজ। ধুমধাম করে বিয়ে হয় সেদিন। গ্রামের সবাই আনন্দে হই-হুল্লোড় করে। বিয়ের পর থেকে বাউল জীবনের ইতি ঘটে রমিজের। একসময়ে বাউল গানের প্রতি নেশা ছিল তার। বিয়ের পর ছেড়ে সংসারে মন দেয়।

বিয়ের বছরখানেক পর ফুটফুটে রাজপুত্র আসে তাদের পরিবারে। ছেলের নাম রাখে হামজা। তার বছর পরই আসে রাজকন্যা। নাম রাখে ফাতেমা। হামজা ও ফাতেমাকে ঘিরে রমিজ-রোজিনা দম্পতির ঘর আলোকিত হয়ে ওঠে।

একসময় রমিজ ছেলে ও মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। দুজন পড়ালেখা করতে থাকে মনের সুখে। কোনো কিছুতেই কমতি রাখে না বাবা রমিজ। বাবা আদর ও ভালোবাসা পেয়ে পড়ালেখায় মেধা নিয়ে এগিয়ে যায় দুই ভাইবোন। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় পা রাখে হামজা। মেয়ে কলেজে উঠতেই বিয়ের আলাপ আসে। পাত্র আমেরিকায় থাকে। সবকিছু পছন্দসই হওয়ায় বিয়ে হয়ে যায় ফাতেমার। ফাতেমা স্বামীর সঙ্গে চলে যায় আমেরিকা। ওদিকে হামজা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে কৃতিত্বের সঙ্গে। যোগ দেয় অধ্যাপনায়। কিছু দিন পর সেও ডিগ্রি নিয়ে চলে যায় ইংল্যান্ডে।

ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হয়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখে। ওদিকে রমিজ আলী নিজ বসতবাড়িকে আঁকড়ে ধরে ভীষণভাবে। জীবনের ঘানি আজও টানে সে। বয়সের বার্ধক্য দমিয়ে রাখতে পারে না তাকে। নিজের জমিজমাতে কাজকর্ম করে আর ছেলেমেয়ের মঙ্গল কামনায় তার দিন-রাত যায়। রমিজ আলী ও রোজিনা বিবি গ্রামের ঘরে শান্তির ছায়া খুঁজে বেড়ায়। বিদেশ তাদের মনে ধরে না। গ্রামের বাড়িতে দুমুঠো খাবারের মাঝে পরম স্বাদ খুঁজে ফেরে। মনে কোনোরকম দুঃখ নেই, ভয়ভীতি নেই।

রমিজ আগে থেকেই মিশুক স্বভাবের। তাই গ্রামের সবার সঙ্গে মিলিমিশে দিন কাটাতে থাকে। বিদেশ থেকে ছেলেমেয়ে টাকা পাঠায়। সেই টাকায় তার সংসারের অভাব যেন আস্তে আস্তে উড়াল দেয়। মেয়ে ফাতেমা ও ছেলে হামজা বিদেশ থেকে বাবা-মায়ের হাতখরচের জন্যও টাকা পাঠায়। তাদের পছন্দমতো জিনিস কিনে খেতে বলে ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়ের ভালোবাসায় রমিজ-রোজিনার সুখের কোনো কমতি নেই।

এমন সুখ নিয়েই তাদের সংসারে চাঁদের মেলা। রমিজ গ্রামের বাজারে সমবয়সিদের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় মেতে উঠে রোজ সন্ধ্যায়। সেই ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে ধানের মাঠে। জীবন যেন ছন্দে ছন্দে সাজবেলা তার। রমিজের জীবনের হিসেব-নিকেশ নিয়ে ভাবনা নেই এই বয়সে। চাওয়া-পাওয়ার নেই ঝামেলা। বড়ই সুখের জীবন তার।

হেমন্তরে এমনি এক দিন মাঠে কাজ করছিল রমিজ। রোদের একঝলক আলোয় চোখে-মুখ ঝলসে ওঠে। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায় রমিজ। নীল আকাশে চোখ পড়ে তার। দেখতে পায়, আকাশে পাখি আর পাখি। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির উড়াউড়ি মনটা তার ভীষণ রাঙিয়ে দেয়। রমিজ ভাবে, পাখির জীবন কত আনন্দের! মুক্ত জীবন নিয়ে ঘোরাঘুরি করে পাখিগুলো। আকাশে পাখি দেখে আর একা একা হাসে সে। চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ নীল আকাশের পানে। আকাশের নীলের নীল যেন ছুঁয়ে যায় তার মনকে।

রমিজের মন এখন আকাশের মতোই উদার। জমির আইলে বসে রমিজ খুশির বানে গেয়ে ওঠে- ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা...।’

গান গাওয়া শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জমিনের আলে বসে নীরবে, নিভৃতে একাকী। দুচোখ থেকে ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু। দেশ, মা, মাটির ভালোবাসার বাঁধন বুকের গভীরে তার। ছেলেমেয়ে বিদেশে গেলেও তার মনকে বিদেশ টানতে পারে না। দেশ নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাউলের একতারা সুর বেজে উঠে কানে।

বাউল গান শুনতে পেয়ে মাঠ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। মাথার গামছা খুলে হাতে নেয়। সে হাঁটতে থাকে বাড়ির পথে। নীল আকাশ যেন স্বপ্ন বসত গড়ার ইঙ্গিত দেয় জীবনের। বাঁশির টান জাদুর টানে মর্মরে সুর তোলে। সেই সুরে হারিয়ে যায় মন অতীত দিনের খোঁজে। জীবন পৃষ্ঠার পাতা যেন উল্টাতে থাকে রমিজ। জীবন ডায়েরির আয়নায় ওই নীল আকাশ জ্বলজ্বল করছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close